একজন প্রিমিয়ার লীগ তারকা হওয়া মোটেও কোন ছোট বা সহজ ব্যাপার নয়। এই লীগে খেলা প্রত্যেকটি খেলোয়াড়ের উপর আকাশ সমান চাপ থাকে ভালো খেলার জন্য, যে চাপে ভালো থেকে ভালো প্রতিভাও ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
কিন্তু এমন অনেক খেলোয়াড়ও থাকেন যাদের এই লীগে ভালো খেলার পূর্ববর্তী নজির থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ একটি মৌসুমে নিজেদের ক্ষমতার চেয়ে অনেকগুণ নিচে পারফর্ম করে বসেন, যেখানে তাদেরকে কেবল তাদের নিজেদের ছাঁয়ার সমতূল্যই মনে হয়ে থাকে।
এমনটি হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে তা হয় একটি আগা গোড়া বিপর্যস্ত দলে খেলা, আবার অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে খেলোয়াড় নিজেই ক্লাবটিতে মানিয়ে নিতে পারছেন না, আবার অনেক সময় এমনটি হয় ব্যক্তিগত বা শারিরিক সমস্যার কারণে। তবে কারণ যাই হোক না কেন, যখন এমনটি ঘটে, তখন তা দেখতে, বুঝতে এবং সহ্য করতে দর্শকদের খুব বেগ পেতে হয়।
এখন চলুন দেখে নেওয়া যাক আমাদের বানানো সদ্য সমাপ্ত প্রিমিয়ার লীগ মৌসুমের সবচেয়ে হতাশাজনক খেলোয়াড়দের একাদশটি এবং আরো জেনে নেওয়া যাক কেনই বা আমরা তাদেরকে তালিকাটিতে অন্তর্ভুক্ত করেছি।
গোলকিপার – ক্যাস্পার স্মাইকেল (লেস্টার সিটি) [Goalkeeper – Kasper Schmeichel (Leicester City)]
এটি বলা মোটামোটি নিরাপদ এবং যুক্তিসঙ্গত যে, ক্যাস্পার স্মাইকেল একটি বাজে মৌসুম পার করেছেন, এবং এই মৌসুমটিকে তিনি চাইবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে। এর ঠিক আগের মৌসুমেই যে স্মাইকেল লেস্টারের এফএ কাপ শিরোপা জয়ের নায়ক ছিলেন, এবারের মৌসুমে সেই স্মাইকেলকে একদমই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
লেস্টার এই সিজনে মোট ৫৯টি গোল হজম করেছে, যা এই সিজনে প্রিমিয়ার লীগ টেবিলের শীর্ষ ১০ এ থাকা যেকোন দলের জন্য সর্বোচ্চ।
কোচ ব্রেন্ডান রজার্স এ ব্যাপারে খুবই মনক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন যে, তার দল এবারের মৌসুমে যথেষ্টের চেয়ে অনেক কম ক্লিন শিট রাখতে সক্ষম হয়েছে। শুধু ক্লিন শিট না রাখতে পারার কারণেই লেস্টারকে প্রিমিয়ার লীগসহ প্রত্যেকটি প্রতিযোগিতাতেই অনেক বেগ পেতে হয়েছে।
রাইট ব্যাক – ডিয়োগো ড্যালো (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) [Right Back – Diogo Dalot (Manchester United)]
যেহেতু অ্যারন ওয়ান-বিসাকাকে শুরু থেকেই রাল্ফ রাঙনিকের তেমন একটা পছন্দ হয়নি, তাই ইউনাইটেডের ব্যাক আপ রাইট ব্যাক ডিয়োগো ড্যালোর সামনে একটি সুযোগ ছিল পজিশনটি চিরকালের জন্য নিজের করে নেওয়ার।
কিন্তু, এই প্রতিভাবান পর্তুগিজ খেলোয়াড় নিজেকে একদমই তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। ইতালির ক্লাবে খেলার সময় তিনি যে প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছিলেন, সেই প্রতিভার একাংশও তিনি ইউনাইটেডের জার্সি গায়ে দেখাতে পারেননি।
যদিও ইউনাইটেডের পুরো রক্ষণভাগের অবস্থা মৌসুমজুড়েই বেশ দূর্বিষহ ছিল, তবুও এ কথা না বললেই নয় যে, ড্যালো দলে সুযোগ পাওয়ার পর থেকে তা আরো খারাপের দিকে পা বাড়ায়। আক্রমণভাগে তার কিছু অবদান থাকলেও, ডিফেন্সিভ খেলায় তিনি পুরোপুরিভাবে অপরিপক্কতার প্রমাণ দিয়েছেন।
কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে, তার প্রধান শক্তি (ক্রসিং) প্রদর্শনেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। পরবর্তী মৌসুমে এরিক টেন হাগের অধীনে তিনি খেলার কতটুকু সুযোগ পান তাই এখন দেখবার বিষয়।
সেন্টার ব্যাক ১ – হ্যারি ম্যাগুয়াইয়ার (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) [Centre Back 1 – Harry Maguire (Manchester United)]
হ্যারি ম্যাগুয়াইয়ারই কি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের করা সর্বকালের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সাইনিং?
এ প্রশ্নের জবাব এখনও অনেকেই খুঁজে চলেছেন। কিন্তু, সত্যকে স্বীকার করে নিতেই হবে, এবং সেই সত্যটি হচ্ছে যে, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন অবসর নেওয়ার পর থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড প্রচুর এমন বাজে সাইনিং করিয়েছে। এটির সংখ্যা এতই বেশি যে কোনটা থেকে কোনটা বেশি খারাপ তা বুঝে ওঠাই দায়।
তবে, হ্যারি ম্যাগুয়াইয়ার হচ্ছেন পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ডিফেন্ডার, এবং তার নিন্দুকদের ভুল প্রমাণিত করার জন্য তিনি একদমই যথেষ্ট পারফর্ম করতে পারেননি, এবং পারছেনও না।
সদ্য সমাপ্ত মৌসুমটিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হল ডি-বক্সের ভেতরে আসা ক্রস ঠিকমত ডিফেন্ড করতে না পারা। লীগ টেবিলের শীর্ষ ১০ এ থাকা সকল দলের মধ্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডই সরাসরি ক্রস থেকে সবচেয়ে বেশি গোল হজম করেছে।
আপনি যদি হ্যারি ম্যাগুয়াইয়ারের উচ্চতার দিকে তাকান, তাহলে এই পরিসংখ্যানটি আপনাকে আরো বেশি অবাক করবে। কোন কারণ ছাড়া মৌসুম শেষে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর গোল ডিফারেন্স “শূন্য” থাকে না। এবং সেইসব কারণের মধ্যে অন্যতম হলেন হ্যারি ম্যাগুয়াইয়ার নিজেই।
সেন্টার ব্যাক ২ – জুনিওর ফির্পো (লিডস ইউনাইটেড) [Centre Back 2 – Junior Firpo (Leeds United)]
জুনিওর ফির্পো লিডস ইউনাইটেডের সেই ডিফেন্সের অংশ যে ডিফেন্স এই একটি মৌসুমেই ৭৯টি গোল হজম করেছে। এই সংখ্যাটি এবারের মৌসুমের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। লিডসের চেয়ে বেশি গোল হজম করেছে একমাত্র রেলিগেটেড নরউইচ সিটি।
কিন্তু বার্সেলোনা থেকে লিডস ইউনাইটেডে যোগ দেওয়া জুনিওর ফির্পো নিশ্চয়ই নিজের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশিই আশা করেছিলেন। আর যাই হোক, এটি প্রিমিয়ার লীগে তার প্রথম মৌসুম হলেও লিডস সমর্থকদের তার কাছে থেকে এর চেয়ে অনেক বেশিই কামনা ছিল।
লিডসের জন্য ভাগ্য শেষ পর্যন্ত সুপ্রসন্ন হয়েছে এবং তারা রেলিগেশন এড়িয়ে প্রিমিয়ার লীগে অবস্থান করতে সক্ষম হয়েছে। তবে, পরবর্তী মৌসুমেও বিপদে না পড়তে চাইলে হয়তো তাদেরকে তাদের রক্ষণভাগকে নতুন করে সাজাতে হতে পারে, এবং জুনিয়র ফির্পো সেই নতুন আঙ্গিকের ডিফেন্সের অংশ নাও হতে পারেন।
অধিকন্তু, আশা করা যায় যে তার নিজের ভালোর জন্যই তিনি আমাদের সকলকে প্রিসিজনে ভুল প্রমাণ করবেন, লিডসের মূল একাদশে নিজের জায়গা ধরে রাখবেন, এবং সবাইকে দেখিয়ে দেবেন যে লিডস আসলেই বার্সা থেকে একজন সুপারস্টারকেই কিনেছে।
লেফট ব্যাক – লুক শ (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) [Left Back – Luke Shaw (Manchester United)]
২০২০-২১ মৌসুমের শেষের দিকে এই ব্যাপারটি নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলছিল যে ইউরো ২০২০ এ ইংল্যান্ডের লেফট ব্যাক পজিশনে কে খেলবেন — বেন চিলওয়েল না লুক শ? ইংল্যান্ড কোচ গ্যারেথ সাউথগেট শুধুমাত্র লুক শ’কে খেলিয়েছেন তাই নয়, তিনি রীতিমত তাকে প্রত্যেকটি ম্যাচের প্রত্যেকটি মিনিটই খেলিয়েছেন। আর তার বিনিময়ে লুক শ তাকে পুরষ্কারও দিয়েছিলেন বেশ কিছু স্মরণীয় পারফর্মেন্স। ইউরোর ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে ম্যাচের একদম শুরুতেই একটি গোলও করেছিলেন শ।
এরপর যদি আমরা এক ধাপ এগিয়ে এক বছর পরের অবস্থা দেখি, তাহলে দেখা যাবে যে, এই সাবেক সাউথ্যাম্পটন লেফট ব্যাক রেড ডেভিলদের মূল একাদশের হয়ে কেবলমাত্র মাঠে নামার সুযোগটিও পাচ্ছেন না। তবে কিভাবে হল তার এমন পতন? এবারই কি প্রথম?
না, ২০১৪ সালে ম্যান ইউনাইটেড এ যোগ দেওয়ার পর থেকেই লুক শ বেশ কিছু উত্থান পতনের শিকার হয়েছেন। তবে ৮ বছর ক্লাবে পার করার পর তার জন্য অর্জন হিসেবে তেমন কিছুই নেই। যদিও যতবারই মনে হয়েছে যে তার ক্যারিয়ার শেষ, ততবারই তিনি ফিনিক্সের মত করে অ্যাশেজ এর মধ্যে থেকে নিজেকে বের করে এনেছেন এবং সবাইকে ভুল প্রমাণিত করেছেন, তবুও যেহেতু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে এবার ম্যানেজার পদে রদবদল হয়েছে, তাই এই ক্লাবে তার ভবিষ্যৎ আর দেখছেন না অধিকাংশ ফুটবল বোদ্ধারাই।
মিডফিল্ডার ১ – পল পগবা (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) [Midfielder 1 – Paul Pogba (Manchester United)]
পল পগবার জন্য ২০২১-২২ মৌসুমটি শুরু হয়েছিল রকেটের গতিতে। মৌসুমের প্রথম ম্যাচেই তিনি চার চারটি এসিস্ট পাওয়ার পর মনে হয়েছিল যেন শেষ পর্যন্ত তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি গায়ে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। ওল্ড ট্রাফোর্ডে বসে খেলা দেখা সেদিনের হাজারো ইউনাইটেড সমর্থকরাও নিশ্চয় তাই ভেবেছিলেন।
মৌসুমের প্রথম চারটি ম্যাচে পল পগবার এসিস্টের সংখ্যা ছিল ছয়টি। কিন্তু তারপর থেকে দলের সাথে সাথে তার নিজের ফর্মেও ভাঁটা পড়ে, এবং বাকি মৌসুমজুড়ে তিনি আর মাত্র একটি গোল এসিস্ট করতে সক্ষম হোন।
এবং এটিই যেন ওল্ড ট্রাফোর্ডের ক্যারিয়ারে পল পগবার এখন পর্যন্ত নিত্যদিনের কাহিণী! জাতীয় দলের জার্সি গায়ে অথবা জুভেন্টাসের হয়ে খেলা তার শেষ দুই বছরের মত ধারাবাহিকতা তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে একটুও দেখাতে পারেননি। ইঞ্জুরি সমস্যা থাকুক বা না থাকুক, দায় পগবার নিজেরই।
সদ্য সমাপ্ত সিজনটির সমাপ্তির সাথে সাথে পগবার চুক্তির মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়েছে, এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে এখন পগবাকে ফ্রিতে বিক্রি করে দিতে হবে। এটিই প্রথম নয়। বেশ কিছু বছর আগে একজন ইয়াংস্টার হিসেবেও তাকে ম্যান ইউনাইটেড ফ্রিতেই বিক্রি করেছিল জুভেন্টাসের কাছে।
মিডফিল্ডার ২ – জর্জিনহো (চেলসি) [Midfielder 2 – Jorginho (Chelsea)]
এটি খুবই বিষ্ময়কর ব্যাপার যে ঠিক এক বছর আগেই জর্জিনহো চ্যাম্পিয়নস লীগ ও ইউরো ২০২০ জেতার পাশাপাশি ফিফা ব্যালন ডি’অর পুরষ্কারের শীর্ষ তিনে জায়গা করে নিয়েছিলেন, কারণ তার ঠিক এক বছর পরে এখন তিনি চেলসি’র মূল একাদশে নিজের জায়গাটিও ধরে রাখতে পারছেন না।
যদিও আপনি বলতে পারেন যে, চেলসি’র দলে বেশ কিছু মানসম্পন্ন মিডফিল্ডার রয়েছে, কিন্তু তার আগের মৌসুমেই চেলসি ও ইতালির হয়ে জর্জিনহো যেমন পারফর্ম করেছিলেন, তার ভিত্তিতে প্রত্যেকটি ম্যাচেই তার দলে জায়গা করে নেওয়া উচিৎ।
কিন্তু, জর্জিনহো শুধুমাত্র চেলসি’র মূল একাদশে জায়গা করে নিতে হিমসিমই খাননি, বরং তার সামনে যখন বিভিন্ন সময়ে সুযোগ এসেছে, তিনি সেগুলি লুফে নিতেও সক্ষম হোননি।
গুজব ছড়াচ্ছে যে হয়তো বা জর্জিনহো এবারের ট্রান্সফার সিজনে এএস রোমা অথবা জুভেন্টাসে পাড়ি জমাতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে বলাই বাহুল্য যে, তিনি যদি চেলসি’র হয়ে একটি শ্রেয় মৌসুম পার করে থাকতেন, তাহলে দলবদলের বাজারে তার মূল্য নিঃসন্দেহে আরো বেশি থাকতো।
মিডফিল্ডার ৩ – ব্রুনো ফার্নান্দেজ (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) [Midfielder 3 – Bruno Fernandez (Manchester United)]
ব্রুনো ফার্নান্দেজ হলেন এই মৌসুমের সবচেয়ে বড় হতাশাগুলির মধ্যে অন্যতম, বিশেষ করে যখন আপনি খেয়াল করবেন যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবারের মৌসুমের শুরুতে কত টাকা খরচ করে দল সাজিয়েছে এবং ব্রুনো তার আশেপাশে এসিস্ট করার জন্য কত মানসম্পন্ন স্ট্রাইকার বা উইংগারদের পেয়েছেন।
জ্যাডোন স্যানচো এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মত বড় বড় নাম দলে ভেড়ানোর পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভক্ত সমর্থকরা সকলেই হয়তো আশায় ছিলেন যে এই পর্তুগিজ সুপারস্টার তার আগের মৌসুমের ফর্ম ধরে রাখবেন এবং এসিস্টের বন্যা বওয়াবেন। ইউনাইটেড সমর্থকদের প্রিয়পাত্র ব্রুনো কিন্তু তা করতে সম্পূর্ণরূপেই ব্যর্থ হয়েছেন।
এছাড়াও, ফার্নান্দেজ এর জন্য আরো বড় চিন্তার বিষয় হল, তিনি যে শুধু বাজে খেলেছেন তাই নয়, নানা দিক দিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মৌসুমজুড়ে যেসব ম্যাচে তিনি খেলেননি, সেসব ম্যাচেই বরং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিছুটা ভালো খেলেছে। তিনি এই মৌসুমে সকল প্রতিযোগিতা জুড়ে কেবলমাত্র ১০টি গোল করতে সক্ষম হয়েছেন, যা তার আগের সিজনে তার করা সর্বমোট ২৮টি গোলের নিকট একদমই মৃয়মান।
স্পোর্টিং লিসবন এর এই সাবেক খেলোয়াড় রেড ডেভিলদের সাথে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে এবারই প্রথম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড চ্যাম্পিয়নস লীগে নিজেদের নাম লেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
রাইট উইংগার – হাকিম জিয়েশ (চেলসি) [Right Winger – Hakim Ziyech (Chelsea)]
প্রিমিয়ার লীগে নতুন খেলতে এসে অনেক তরুণ খেলোয়াড়দেরই প্রথম সিজনে খুব বেগ পেতে দেখা গিয়েছে। তাই, ডাচ দল আয়াক্স আমস্টারডামে অসাধারণ ক্রীড়ানৈপূণ্য প্রদর্শন করা হাকিম জিয়েশ যখন চেলসির হয়ে প্রিমিয়ার লীগে নাম লিখালেন, তখন অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে লীগের সাথে তার খাপ খাইয়ে নিতে একটি সিজন প্রয়োজন হতেই পারে। এবং হলও তাই। কিছু গুরুত্বপূর্ণ গোল ও এসিস্ট নিজের নামে করলেও প্রত্যাশার ধারে কাছেও যেতে পারেননি তিনি তার প্রথম সিজনে। কিন্তু তার সেরা খেলার কিছু ঝলক দেখেই অনেক ফুটবল বোদ্ধারা ধরে বসেছিলেন যে হাকিম জিয়েশ ২০২১-২২ সিজনে চেলসি’র অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন। তাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী মুখ থুবড়ে পড়েছে।
ইঞ্জুরি, বাজে ফর্ম এবং ধারাবাহিকতার অভাবে জর্জরিত এই মৌসুমে তাই জর্জিনহোর মতই হাকিম জিয়েশও তেমন একটা সুযোগই পান নি চেলসি’র মূল একাদশে। পুরো সিজন জুড়েই চেলসি গোলের সামনে খুব একটা সফলতার দেখা পায়নি, এবং সেটির জন্য অনেক বড় একটি দায় বর্তায় দলটির উইংগারদের উপর, যারা মোটেও তাদের বুদ্ধিমত্তার সদ্ব্যবহার করতে পারেননি, এবং তাদেরই মধ্যে অন্যতম হলেন হাকিম জিয়েশ।
তার উপরে আবার অনেক চেলসি সমর্থকই মনে করেন যে, হাকিম জিয়েশকে দেখলে নাকি তাদের মনেই হয়না যে তিনি দলের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে খেলছেন। এ ব্যাপারে মুখ না খুললেও জিয়েশ কিন্তু তার খেলা দিয়ে মোটেও সেসকল সমর্থকদের মুখ বন্ধ করতে পারেননি।
লেফট উইংগার – আলেকজান্ডার ল্যাকাজেট (আর্সেনাল) [Left Winger – Alexandre Lacazette (Arsenal)]
যেসকল কারণে আর্সেনাল এই মৌসুমে শীর্ষ চারে থাকতে এবং আগামী মৌসুমের জন্য চ্যাম্পিয়নস লীগ ফুটবল নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল গোলের অভাব। যদিও আগের মৌসুমের থেকে এই মৌসুমে তাদের ডিফেন্সে অনেক উন্নতি হয়েছে, তবে আক্রমণভাগের ধার তাদের অনেকটাই কমে গিয়েছে।
মৌসুমের শুরুর দিকেই কোচ মিকেল আর্তেতা’র সাথে স্ট্রাইকার এবং আগের মৌসুমের টপ স্কোরার পিয়ের এমেরিক অবামেয়াং দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন এবং জানুয়ারির ট্রান্সফার উইন্ডোতে দল ছেড়ে বার্সেলোনায় যোগ দেন। এরপর থেকেই নর্থ লন্ডনের দলটির জন্য গোল করার গুরু দায়িত্ব এসে পড়ে ফরাসি স্ট্রাইকার আলেকজান্ডার ল্যাকাজেট এর উপর।
কিন্তু, এই সাবেক লিওঁ স্ট্রাইকার দলটির হয়ে মাত্র ছয়টি গোল করতেই সক্ষম হোন, যা তার আর্সেনাল ক্যারিয়ারে একটি মৌসুমের জন্য সর্বনিম্ন গোল সংখ্যা। ২০১২-১৩ মৌসুমের পর এটিই ল্যাকাজেট এর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে মৌসুম। সেই সিজনে তিনি মাত্র ৪টি গোল করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আর এমন খারাপ ফর্মের জের ধরেই এখন তাকে আর্সেনাল ছাড়তে হচ্ছে। এডি এনকেটিয়া’র পাশাপাশি আরেকজন ফরোয়ার্ডকে দলে ভিড়িয়ে তাই আর্সেনাল ল্যাকাজেটের অভাব পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সেন্টার ফরোয়ার্ড – রমেলু লুকাকু (চেলসি) [Centre Forward – Romelu Lukaku (Chelsea)]
রমেলু লুকাকু ছিলেন এই সম্পূর্ণ মৌসুমের অন্যতম বড় ফ্লপদের মধ্যে একজন। ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানের হয়ে প্রচুর গোল করে এবং তাদেরকে সিরি আ শিরোপা বা স্কুদেত্তো জিতিয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে ফেরা লুকাকুকে নিয়ে অনেক চেলসি সমর্থকই স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, হয়তো শেষ পর্যন্ত লুকাকু তার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দুস্বপ্নময় সময়টিকে পেছনে ফেলতে পেরেছেন।
কিন্তু, ধীরে ধীরে তার অতীতের বদ অভ্যাসগুলি আবারো সামনে আসতে শুরু করে। তার অতি ভারী টাচ এবং গতির স্বল্পতা বহু সংখ্যক চেলসি অ্যাটাককে মৌসুম জুড়েই ব্যাহত করেছে।
এ পর্যন্তও ঠিক ছিল। প্রধান সমস্যার শুরু হয় তারও পরে। হঠাৎ করে সিজনের মাঝামাঝি লুকাকু বিভিন্ন ইন্টারভিউ এ উপস্থিত হতে শুরু করলেন। এমনি একটি ইন্টারভিউয়ে তিনি চেলসি এর ম্যানেজমেন্ট এবং কোচ থমাস টুখেলকে নিয়ে কিছু কটুক্তি করেন এবং আবারো ইন্টার মিলানে ফিরে যাওয়ার আশা ব্যক্ত করেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই তার উপর থেকে মন উঠে যায় সকল চেলসি সমর্থকদের এবং কোচ টুখেলেরও। এর পর থেকে অনিয়মিতভাবে দলে সুযোগ পেয়েছেন এই বেলজিয়ান, এবং যখনই খেলেছেন, তার নিজ দলের ভক্তদের কাছ থেকেও তেমন একটা সমর্থন পাননি।
এই সাবেক এভারটন ফরোয়ার্ড এই মৌসুমে সকল প্রতিযোগিতা মিলিয়ে করেছেন মাত্র ১৫টি গোল, যার মধ্যে শুধুমাত্র ৮টি গোল এসেছে প্রিমিয়ার লীগে। রেকর্ড ফি দিয়ে কেনার সময় নিশ্চয়ই এর চেয়ে বেশি আশা করেছিল চেলসি।
শেষ মন্তব্য (Final Verdict)
এই তালিকার সকল খেলোয়াড়দের জন্যই ২০২১-২২ মৌসুমটি ছিল বেশ কঠিন এবং ভুলে যাওয়ার মত। তবে এখানেই শেষ নয়। এরা সকলেই দ্বিতীয় সুযোগ পাবেন, তা হোক তাদের বর্তমান ক্লাবেই, অথবা অন্য কোন দেশের অন্য কোন ক্লাবে। তবে আগামী মৌসুমেই তাদের মধ্যে যারা নিজেদের আসল রূপে ফিরে আসতে পারবেন, কেবল তারাই তাদের ক্যারিয়ার ধরে রাখতে পারবেন। কারণ, পর পর দুই সিজন খারাপ খেলে কোন খেলোয়াড় ভালো কোন দলে টিকে থেকেছেন এরকম নজির খুব কমই দেখা গিয়েছে।
এখন শুধু দেখার বিষয় এই যে, তারা আগামী মৌসুমে কেমন পারফর্ম করতে পারেন, এবং কে জানে? হয়তো তাদের মধ্যেই কেউ কেউ আগামী মৌসুম শেষে প্রিমিয়ার লীগের সেরা একাদশেও জায়গা করে নিতে পারেন। হ্যাঁ, ফুটবল এমনই অনিশ্চয়তার খেলা!