ফুটবলের এক অবিসংবাদিত চারণভূমি হল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নামক ইংলিশ ক্লাবটি। এমনি এক ঐতিহ্যবাহী ফুটবল সাম্রাজ্যের বর্তমানের শোচনীয় পরিস্থিতি শুধুমাত্র রেড ডেভিল সমর্থকদের জন্যই হতাশাজনক নয়, বরং পুরো ফুটবল বিশ্বই হয় এ ব্যাপারে আশাহত, অথবা আশ্চর্যান্বিত। এক সময়ে ইংলিশ ফুটবলে রাজত্ব করে আসা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আজ গড়পড়তা ফুটবলের নিম্নতম স্তরে পতিত হয়েছে। পর্বতচূড়া থেকে তারা এতটাই নিচে পড়ে গিয়েছে যে, আবার উপরে ওঠা তো অনেল দূরের ব্যাপার, এর চেয়ে বেশি নিচে পড়ে যাওয়া হয়তো আর সম্ভবই না।
স্যার আলেক্স ফার্গুসন দলটির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড মাত্র পাঁচটি শিরোপা জিততে সক্ষম হয়েছে, তবে তার মধ্যে একটিও ইংলিশ ফুটবলের তাজ প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা নয়। তার মানে, তারা গত দশ বছরে মাত্র ৫টি শিরোপা জিতেছে। এমন রেকর্ড ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মত ক্লাবের জন্য শুধু দুশ্চিন্তার কারণই নয়, বরং তাদের মাপের একটি ক্লাবের জন্য এটি একান্তই লজ্জাজনকও বটে। একজন গড়পড়তা ইউনাইটেড সমর্থকও বুঝবেন যে, এমন পাঁচটি তুচ্ছ শিরোপার চেয়ে একটি মাত্র প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা জয়ই অধিক গর্বের।
অবশ্যই, ব্যর্থতার স্রোতে ভেসে নদী কিনারে আছড়ে পড়েছিল অনেকেরই ক্লান্ত দেহ। ২০১৩ সালের পর থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ৫ জন আলাদা আলাদা ম্যানেজারের হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দিয়েছে (ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার রাল্ফ রাঙনিককে ধরলে ৬ জন)। যদিও, পরিসংখ্যান যাচাই করে দেখলে এ ব্যাপারে কোনই দ্বিমত থাকবে না যে, এই সময়কালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সেরা কোচ ছিলেন পর্তুগিজ স্পেশাল ওয়ান, হোসে মোরিনহো। তবে, এটিও পুরোপুরিভাবে স্পষ্ট যে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যানেজার হিসেবে তিনিই সবচেয়ে বেশি সমালোচনা ও বিদ্রুপের শিকারও হয়েছেন।
যদিও গত পুরো দশক ধরেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সমর্থকদের তাদের দলের কাছ থেকে এমন বাজে ফুটবল দেখে আসতে হচ্ছে, তবুও গত মৌসুমটি ছিল ক্লাবটির জন্য এবং তাদের সকল ভক্ত সমর্থকদের জন্য সবচেয়ে কঠিন এবং শোচনীয় একটি মৌসুম। রেড ডেভিলরা কোনরকম লীগ টেবিলের ৬ষ্ঠ স্থানে থেকে গত মৌসুমটি শেষ করতে পেরেছিল, এবং বেশির ভাগ ফুটবল বোদ্ধাদের মতেই সেটি ছিল তাদের জন্য একটি বড় সাফল্য! এছাড়া, তাদের জন্য আরেকটি লজ্জার বিষয় হল গত মৌসুম শেষে তাদের গোল ব্যবধান ছিল শূন্য (০)। এর বাইরে তারা তাদের দীর্ঘকালীন দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিভারপুল ও ম্যানচেস্টার সিটি’র কাছে সম্পূর্ণরূপে নাকানিচুবানিও খেয়েছিল, তাও আবার হোম এবং এওয়ে উভয় ম্যাচেই।
এমন বাজে একটি মৌসুম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সেসকল আশাবাদী সমর্থকদের জন্য আরো ধ্বংসাত্মক ছিল যারা ভেবেছিল যে তার আগের মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগে ২য় স্থান দখলের পর এবং ইউরোপালীগের ফাইনালে খেলার পর এবার তাদের দল আরো বড় কিছু বা ভালো কিছু অর্জন করতে চলেছে। এছাড়া তাদের গত গ্রীষ্মকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোটিও তাদের সমর্থকদের জন্য ছিল বেশ আশা জাগানিয়া, যেখানে তারা নিশ্চিত করতে পেরেছিল তাদের পোস্টার বয় ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর প্রায় ১৪ বছর পর ক্লাবটিতে ফিরে আসা, এবং সম্পন্ন করতে পেরেছিল জ্যাডোন স্যাঞ্চো এবং রাফায়েল ভারান এর মত বিশ্বমানের খেলোয়াড়দের ট্রান্সফারও।
কিন্তু, সেসব বিগ বাজেট ট্রান্সফার পুরোপুরিভাবে জলে যাওয়ার পর এখন এসে দেখা যাচ্ছে যে, কোন হাই প্রোফাইল খেলোয়াড়ই আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দিতে চাচ্ছেন না। ভাবতেও অবাক লাগে যে, মাত্র কয়েক বছর আগেও এই ক্লাবটিতে যোগ দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকতেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় তারকারা। তাহলে, সেই অবিসংবাদিত ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পতনের পেছনে কি এমন কারণই বা ছিল? এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল যে, কেনই বা এই ঐতিহাসিক ক্লাবে এখন আর ফুটবল বিশ্বের কোন তারকা খেলোয়াড়ই যোগ দিতে চাচ্ছেন না? এসকল প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর খোঁজার লক্ষ্যে চলুন আমরা এগিয়ে যাই।
অপচয়মূলক খরচাপাতি (Wasteful spending)
২০১৩ সালের পর থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নতুন খেলোয়াড়দেরকে দলে ভেড়ানোর উদ্দেশ্যে মোট খরচ করেছে ১ বিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি, এবং আরো ২ বিলিয়ন পাউন্ডের আশেপাশে তারা খরচ করেছে প্লেয়িং বা নন-প্লেয়িং খেলোয়াড় বা কর্মকর্তাদের বেতন প্রদানের পেছনে। এই সময়কালে এটিই হচ্ছে যেকোন ফুটবল ক্লাবের জন্য সর্বোচ্চ ব্যয়ের রেকর্ড। এমন খরচাপাতি আসলেই খুবই দুঃখজনক, বিশেষ করে যখন আপনি এই ব্যাপারটি আমলে নিবেন যে, সদ্য সমাপ্ত মৌসুমটি ছিল অর্জিত পয়েন্টের দিক থেকে গত ৩০ বছরের মধ্যে তাদের সবচেয়ে খারাপ মৌসুম।
পল পগবা এবং এংখেল ডি মারিয়ার মত খেলোয়াড়দেরকে দলে আনতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে গুণতে হয়েছিল বিশাল বড় বড় অঙ্কের চেক। কিন্তু, বিনিময়ে এসব খেলোয়াড়েরা শুধুমাত্র হতাশাই উপহার দিতে পেরেছেন ক্লাবটিকে এবং ক্লাবটির সমর্থকদের। ক্লাব ছাড়ার পূর্বেও তারা নানা ধরণের সমালোচনামূলক কার্যক্রম করে গিয়েছেন। এবারের ট্রান্সফার উইন্ডোতে এমন একটি ট্রান্সফার তারা সম্পন্ন করেছে যা গত এক দশকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ট্রান্সফার ইতিহাসের সবচেয়ে বিপর্যস্ত ট্রান্সফার হিসেবেই পরিচিত থাকবে। সে সময়ের বিশ্ব রেকর্ড ফি দিয়ে কেনার পর এবার পল পগবাকে ফ্রিতেই ইতালিয়ান জায়ান্ট জুভেন্টাসের কাছে হারিয়েছে তারা।
একজন ফুটবল ভক্ত হিসেবে আপনি যখনই ‘অপচয়’ শব্দটি নিয়ে ভাববেন, তখনি নিশ্চয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কথা আপনার মাথায় আসবে। গত বেশ কিছু বছপ্র ধরে ট্রান্সফার মার্কেটে বার বার নানা খেলোয়াড় কেনার ক্ষেত্রে তারা এতটাই দিশেহারার মত আচরণ করেছে যে, এখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন দলই তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন থেকে বাঁঁচবার মাধ্যম হিসেবে রেড ডেভিলদের বেছে নেয়। ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংকে নিয়ে বার্সেলোনার মনোভাবও অনেকটা এমন বলেই মনে হচ্ছে।
এছাড়াও ক্লাবটি বেশ কিছু খেলোয়াড় এর জন্য অতিরিক্ত ট্রান্সফার ফি খরচ করে ফেলেছে, যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাবেক লেস্টার ডিফেন্ডার হ্যারি ম্যাগুয়াইয়ার। যে আশা, ভরসা ও প্রত্যাশা নিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড একজন ডিফেন্ডারের জন্য ব্রিটিশ ট্রান্সফার রেকর্ড ভেঙে হ্যারি ম্যাগুয়াইয়ারকে লেস্টার সিটি থেকে কিনেছিল, তার কিছুটাও পূরণ করতে পারেননি এই হাইলি-রেটেড এই ইংলিশ ডিফেন্ডার। ক্লাবে যোগ দেওয়ার প্রায় কিছুদিন পরেই তাকে দলটির অধিনায়ক হিসেবেও নিয়োজিত করা হয়, কিন্তু সব মিলিয়ে তিনি তার ৮০ মিলিয়ন ইউরো প্রাইস ট্যাগের মান একদমই রাখতে পারেননি।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অধিকাংশ খেলোয়াড়ের বেতনও অন্যান্য দলের খেলোয়াড়দের তুলনায় বেশ চড়াও, যা ক্লাবটির জন্য আরেকটি সমস্যার কারণ। এই পর্যন্ত ক্লাবটির আমেরিকান মালিকরা খরচ ঠিকই করেছেন, কিন্তু তাতে দলের যতটা না ভালো হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ক্লাবটি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে গিয়েছে।
কোচ নির্ধারণে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত (Wrong choice of coaches)
কোচ বিড়ম্বনা ওল্ড ট্রাফোর্ডে এখন একটি চিরাচরিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আমরা এমন কিছু একদমই বলতে চাচ্ছি না যে, ২০১৩ সালের পর থেকে ক্লাবটিতে যত কোচই এসেছেন, তা সকলেই পেশাগতভাবে খারাপ কোচ, তবে ক্লাবটিতে আসার পর দলের ফলাফল এবং খেলার ধরণ দেখে কিন্তু তেমনটিই মনে হতে বাধ্য।
স্যার আলেক্স ফার্গুসন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে শেষবারের মত একটি প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা জিতিয়ে দিয়ে ২০১৩ সালে বিদায় নেন কোচের দায়িত্ব থেকে, এবং নিজের স্কটিশ সতীর্থ ডেভিড ময়েসকে দিয়ে যান তার পদটি। কিন্তু, ডেভিড ময়েস ক্লাবটিতে এসে যে দলটি পেয়েছিলেন, সেই দল থেকে পুরোটা বের করে আনার ক্ষমতা শুধু ফার্গুসনেরই ছিল। ঐসকল গড়পড়তা খেলোয়াড়দের নিয়ে তাই তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। ফার্গুসন কি করে সেই দলটি নিয়ে প্রিমিয়ার লীগে বছরের পর বছর রাজত্ব করেছেন, তা সত্যি খুবই আশ্চর্যের বিষয়।
যাই হোক, ময়েসের ট্যাকটিক্স খুবই অস্পষ্ট এবং ত্রুটিময় ছিল, যার কারণে তারা সকল প্রতিযোগিতাতেই সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকে। স্যার আলেক্স ফার্গুসন বিদায় নেওয়ার পর থেকে সবচেয়ে খারাপ যেসব মৌসুম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড পার করেছে, সেই তালিকায় সবার উপরে গত মৌসুম (২০২১-২২) থাকলেও তার পরেই হয়তো জায়গা করে নিবে ২০১৩-১৪ এর সেই মৌসুমটি।
এর পরেই ইউনাইটেড এর দায়িত্ব চলে যায় ডাচ কিংবদন্তি কোচ লুইস ভ্যান গাল এর ঘাড়ে। ক্লাবটিতে যোগ দেওয়ার ঠিক আগেই তিনি ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডস এর হয়ে ব্রোঞ্জ পদক অর্থাৎ তৃতীয় স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তার ক্রীড়া কৌশল ছিল মূলত পজিশন ভিত্তিক। ম্যাচের বেশির ভাগ সময় ধরে বল পজিশন নিজেদের দখলে রাখা এবং বল হারালেই প্রতিপক্ষের উপর চরম পরিমাণে প্রেসিং করার মাধ্যমে তার দলগুলি খেলে এসেছে চিরকাল। অন্য সবখানেই তিনি এই ট্যাকটিক ব্যবহার করে সাফল্য পেলেও, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে তিনি পজিশন রাখতে পারলেও, সেই পজিশনকে তার দল গোলে রূপান্তরিত করতে পারতো না। এর ফলে দলের ফলাফলে ভাঁটা পিড়ে, এবং লুইস ভ্যান গাল তার চাকরি হারান।
এর পর থেকেও যেসকল ম্যানেজাররা ইউনাইটেড এর দায়িত্ব নিয়েছেন, শুরুতে তারাও তাদের নিজস্ব ক্রীড়া কৌশল প্রয়োগ করে কিছু ম্যাচ জিতেছেন এবং প্রশংসাও কুড়িয়েছেন, কিন্তু যতই সময় পার হয়েছে, দলের ফলাফল ততই খারাপের দিকে অগ্রসর হয়েছে, এবং ক্লাবের সমর্থকরা পেয়েছেন শুধু হতাশা। গত দশ বছরের মধ্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সবচেয়ে সফল কোচ ছিলেন হোসে মোরিনহো। ক্লাবটির হয়ে তিনি তিনটি শিরোপা জিতলেও তার ক্রীড়া কৌশলকে অনেকেই খুবই একঘেঁয়ে বলে আখ্যায়িত করেন।
মোরিনহোর পরে ইউনাইটেডের ম্যানেজার হয়ে আসেন ভক্তদের প্রিয় ওলে গানার সলসকিয়ের। গত এক দশকে ম্যান ইউনাইটেডের দ্বারা ব্যবহৃত সকল কোচের মধ্যে বোধ হয় তিনিই সবচেয়ে কম যোগ্য ছিলেন, কারণ তার চাকরিটি পাবার পেছনে এবং ধরে রাখার পেছনে কেবল একটি কারণই ছিল, এবং সেটি হল যে, ক্লাবের সমর্থকরা তাকেই পদটিতে দেখতে চেয়েছিলেন।
তিনি তার স্বল্প কোচিং বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে মাঠে ও মাঠের বাইরে নানাবিধ কৌশলই প্রয়োগ করে দেখেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে তিনি খেই হারিয়ে ফেলেন এবং তৎক্ষনাৎ চাকরি হারান। এরপর আসেন রাল্ফ রাঙনিক, এবং তার ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করাও খুবই একঘেঁয়ে এবং বিরক্তিকর একটি বিষয়।
কোনরকম স্থায়ী ক্রীড়াকৌশলের অনুপস্থিতি (No defined style of play)
যেমনটি ধারণা করা খুবই সহজ, একের পর এক কোচের পরিবর্তনের ফলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে কোন নির্দিষ্ট প্লেয়িং স্টাইলই টিকতে পারেবি বেশিদিন। ইউনাইটেডের দলগত ঐক্য এতটাই খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, অনেক নামকরা বা জনপ্রিয় খেলোয়াড়েরা এই দলে প্রবেশ করেও দলের পারফর্মেন্স তো ভালো করতে পারেনইনি, উলটো নিজেদের ভালো করার সক্ষমতাও হারিয়েছেন। এর পেছনে কারণ হিসেবে বলতে গেলে, দলটির বাজে ক্রীড়া কৌশল বা কোনরকম ক্রীড়া কৌশলেরই অভাব এর দিকেই আংগুল তাক করতে হয়।
যদিও অনেকেই মনে করেন যে, লুইস ভ্যান গালকে চাকরিচ্যুত করা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দিক থেকে একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল কারণ ২০১৩ সালের পর থেকে ইউনাইটেডে আসা কোচদের মধ্যে কেবল তারই একটি বিশেষায়িত ক্রীড়া কৌশল ছিল, তবে এমন মন্তব্যও সম্পূর্ণরূপে যথাযথ নয়, কারণ সেই স্টাইলাইজড ক্রীড়াকৌশলকে কাজে লাগিয়ে তিনি ক্লাবটিকে কোন সাফল্য তো দূরে থাক, একটানা বেশ কিছু ম্যাচও জেতাতে পারেননি।
হোসে মোরিনহো এবং ওলে গানার সলসকিয়ের ইউনাইটেডে একটি কাউন্টার অ্যাটাকিং ফুটবল স্টাইলের প্রবর্তন করেছিলেন, যা মাঝে মাঝে কাজে দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজে দিতো না। বিশেষ করে ওলে গানার সলসকিয়ের এর সময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছোট দলগুলির ডিফেন্স ভাঙতে খুবই হিমসিম খেত, কারণ তার ক্রীড়া কৌশলটি মূলত বড় বা অধিকতর শক্তিশালী দলগুলির বিরুদ্ধে খেলার ক্ষেত্রে অধিক প্রযোজ্য।
রাল্ফ রাঙনিক দলের দায়িত্ব নেন এবং একটি প্রেসিং ভিত্তিক ক্রীড়া কৌশল প্রয়োগের ওয়াদা করেন, কিন্তু মাঠে প্রেসিং তিনি করতে না পারলেও তিনি ইউনাইটেড সমর্থকদের হৃদয়ে অবশ্যই প্রেসিং করতে সমর্থ্য হোন। তার সময়েই ক্লাবটি তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে ফুটবল খেলেছে বলে মনে করেন অধিকাংশ ফুটবল বিশেষজ্ঞ ও বোদ্ধারা।
শিরোপা শূন্যতা (Lack of trophies)
যেকোন ভালো খেলোয়াড় এর জন্যই শিরোপা জেতা একটি বড় ব্যাপার হয়ে থাকে; শিরোপা জেতার যে অসামান্য অভিপ্রায়, সেটিই খারাপ খেলোয়াড়দের থেকে ভালো খেলোয়াড়দের আলাদা করতে সাহায্য করে। বড় বড় এবং ভালো ভালো সব খেলোয়াড়দের নিজ ক্লাবে আকর্ষণ করতে হলে প্রথমেই ক্লাবটির ভেতরে একটি জেতার মানসিকতা তৈরি করতে হয়। কিন্তু, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বিড় মাপের খেলোয়াড়দের জন্য এমন কিছুই অফার করতে পারে না, কারণ সাম্প্রতিক সময়ের উপর ভিত্তি করে এমনটিই মনে হয় যে, যেকোন শিরোপার প্রতি যেন তাদের কোন এক ধরণের এলার্জি রয়েছে।
২০২২-২৩ প্রিমিয়ার লীগ মৌসুম যখন শুরু হউএ যাবে, তখনই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সমর্থকদের একটি ব্যাপার বার বার পিঁড়া দিতে থাকবে, এবং সেটি হল যে, তারা শেষ বার প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা জেতার পর থেকে পুরো ১০ বছর কেটে গিয়েছে। এছাড়া, তারা যেকোন প্রকার শিরোপা জেতার পর থেকেও ছয় ছয়টি বছর কেটে গিয়েছে। এই একটি প্রথা ইউনাইটেডের নতুন কোচ এরিক তেন হাগকে ভাঙতেই হবে, যদি অদূর ভবিষ্যতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ট্রান্সফার মার্কেটে কিছুটা হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়।
যদিও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড মাঠের পারফর্মেন্স এবং ট্রান্সফার মার্কেটে খুবই বাজে একটি সময় পার করছে, তবুও আমাদের মনে রাখতে হবে যে ক্লাব হিসেবে তাদের নিকট এখনো একটি অসাধারণ ঐতিহ্য, একটি অনবদ্য সমর্থক গোষ্ঠী, এবং প্রচুর বাণিজ্যিক সক্ষমতা বাকি রয়েছে। তাদের কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত নতুন সব কর্মকর্তা ও কোচদের তাই মনে রাখতে হবে যে, বেশ কিছু নতুন খেলোয়াড়দের দলে আনতে হবে ঠিকই, কিন্তু সঠিক মূল্যে। খেলোয়াড় কেনায় অর্থের অপচয় পরিহার, এবং একটি সুন্দর ও কার্যকর ক্রীড়া কৌশল প্রয়োগ করতে পারলেই মাত্র ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আবারও তাদের পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে।