ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ হল পৃথিবীর সবচেয়ে নামীদামী এবং আকর্ষণীয় ফুটবল লীগ। বিশ্বখ্যাত সব সুপারস্টার ফুটবলার এবং ঘরোয়া প্রতিভার একটি অসাধারণ সংমিশ্রণ শুধুমাত্র প্রিমিয়ার লীগেই দেখতে পাওয়া যায়। সকল ফুটবলারই স্বপ্ন দেখে থাকেন একদিন না একদিন ইংল্যান্ডের অনবদ্য ফুটবলীয় পরিবেশে খেলতে পারার। অনেকেই সেই স্বপ্নটি পূরণ করতে সক্ষম হলেও, অনেকেই রয়েছেন যারা তাদের সেই স্বপ্নটি বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারেননি।
আরেক দিকে, এমনও অনেক খেলোয়াড় রয়েছেন, যারা প্রিমিয়ার লীগে বিদ্যমান চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রতিযোগিতা দেখে ঘাবড়ে যান, এবং সেখানে পাড়ি জমানো থেকে বিরত থাকেন। আবার অনেকে এমনও রয়েছেন যারা লীগটিতে পাড়ি জমালেও সেই প্রতিযোগিতার সাথে মানিয়ে নিয়ে পারেননি, টিকে থাকতে পারেননি প্রচন্ড চাপ ও তোপের মুখে।
প্রিমিয়ার লীগের সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলির মধ্যে অন্যতম দু’টি — ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং চেলসি — এই দিক দিয়ে অন্যান্য সকল ক্লাবের থেকে বেশি বিদ্রুপের শিকার হয়ে থাকে। উভয় ক্লাবই সাম্প্রতিক সময়ে প্রিমিয়ার লীগে সবচেয়ে বড় ও দামী ফ্লপ খেলোয়াড়গুলি পরিবেশন করেছেন।
যদিও এ ব্যাপারে লিভারপুল এবং আর্সেনালও যথেষ্ট এগিয়ে গিয়েছেন, তবুও উপরিউক্ত ক্লাব দু’টিকে এই দিক দিয়ে বাজিমাত করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এই বিষয়টির সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণ হলেন ফরাসি তারকা ফুটবলার, পল পগবা।
এই বিশ্বকাপ জয়ী ফরাসি সাধারণত ফুটবল মাঠের মধ্যভাগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তাকে ইতালিয়ান জায়ান্টস জুভেন্টাস থেকে ৯০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে একটি ব্লকবাস্টার চুক্তিতে স্বাক্ষর করান রেড ডেভিলরা। সে সময়ে সবাই ভেবেছিল যে, সেটি ছিল এমন একটি ট্রান্সফার যা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তৎকালীন বেহাল অবস্থাকে কিছুটা হলেও দূর করবে। তবে, ইউনাইটেডে অবস্থানকালীন পুরো সময়টাই তিনি কাটিয়েছেন শুধু উচ্চাশা আর প্রত্যাশার চাপে দাবিত হয়ে। সম্প্রতি তার উপর নির্মিত “পগমেন্টারি” নামক একটি প্রামাণ্যচিত্রে তিনি সেই ব্যাপারটি আরো বেশি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন।
এমনি আরো একটি আত্ম-ধ্বংসাত্মক ট্রান্সফার ঘটেছিল, যখন রেড ডেভিলরাই অনেক অর্থের বিনিময়ে কিনেছিল সে সময়ের ইন-ডিমান্ড উইংগার এঞ্জেল ডি মারিয়াকে। ৫৯ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেওয়ার পূর্বে এই আর্জেন্টাইন জাদুকর ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের জন্য একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।
কিন্তু, অনেকের মতই তিনিও তার নতুন ক্লাবে খাপ খাইয়ে নিতে পুরোপুরিভাবে অক্ষম হোন। দলটির হয়ে তিনি তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেননি, এবং দলে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মাথায়ই তিনি দলটি ছেড়ে চলেও যান।
প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাসে এমন অনেক খেলোয়াড়ই রয়েছেন যারা একটি ব্যর্থ এক্সপেরিমেন্ট এর চেয়ে বেশি আর কিছু হিসেবেই গণ্য হবেন না। তবে, আমরা এখানে শুধুমাত্র এমন ১০ জন খেলোয়াড়কে নিয়েই আলোচনা করব। এই তালিকা তৈরির জন্য যেসব তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে খেলোয়াড়টির মূল্য, তার উপরে সমর্থকদের প্রত্যাশার চাপ, এবং খেলোয়াড়ের নিজস্ব দক্ষতা ও যোগ্যতা।
তাহলে চলুন, দেখে নেওয়া যাক যে, কোন ১০ জন খেলোয়াড়েরা হলেন প্রিমিয়ার লীগ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ফ্লপ।
১০. পল পগবা (জুভেন্টাস থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) [10. Paul Pogba (Juventus to Manchester United)]
যদিও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে কাটানো তার ৬ বছরে পল পগবা হাতে গোনা কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত সমর্থকদের উপহার দিতে পেরেছিলেন, তবুও এটি বলাই বাহুল্য যে, ক্লাবটি তার পেছনে যত বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছিল, তার খুব সামান্য একটি অংশই তারা উশুল করতে পেরেছে। ইউনাইটেডে থাকাকালীন তার প্রত্যেকটি মৌসুমই কেটেছে সমালোচনার মধ্যে এবং প্রায়ই তার পেশাদারিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তার বিখ্যাত ফুটবলিং এজেন্ট, (এখন প্রয়াত) মিনো রায়োলা, মাঝে মধ্যেই পগবাকে নিয়ে মন গড়া সংবাদ তৈরি করতেন এবং অদ্ভুত ও অসত্য সব তথ্যও প্রকাশ করতেন, যা খেলার মাঠে পগবাকে অন্যমনস্ক করে দিতো, এবং তার পারফর্মেন্স দূর্বল করে দিত।
তবে, এটিও না বললেই নয় যে, ইউনাইটেডে থাকাকালীন পল পগবা নিজেও একজন নিরুৎসাহিত খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছিলেন, যার কারণে হয়তো তার গা ছেড়ে খেলার ব্যাপারটি আরো বেশি সামনে এসেছে। ট্রেনিং এ এবং খেলার মাঠে তার অঙ্গভঙ্গি দেখে সমর্থকরা অনেকবারই এমনটি ভেবেছেন যে, আদৌ কি তিনি দলটির জন্য উপযুক্ত! বিশ্বকাপ জয়ী এই খেলোয়াড় কখনোই ক্লাবের উন্নতি বা বিকাশের জন্য নিজের সবটুকু বিলিয়ে দেননি, বরং পুরো সময়জুড়েই তিনি শুধু নিজের দিকটাই দেখেছেন।
এখন যখন পল পগবা একটি ফ্রি ট্রান্সফারের বদৌলতে আবারও তার সাবেক ক্লাব জুভেন্টাসে ফেরত যাচ্ছেন, তখন বলতেই হয় যে, প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়দের তালিকায় তিনি নাম লিখাতে পারতেন, যদি তার মনযোগ মাঠে বাইরে না থেকে মাঠের খেলার উপর থাকতো। কিন্তু, ভাগ্যের এ কি পরিহাস! তিনি আজ প্রিমিয়ার লীগের ফ্লপ’দের তালিকায় অবস্থান করছেন।
৯. ফার্নান্দো তোরেস (লিভারপুল থেকে চেলসি) [9. Fernando Torres (Liverpool to Chelsea)]
মার্সিসাইডে থাকাকালীন এই স্প্যানিশ সুপারস্টার ফরোয়ার্ড ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে সেরা এবং বিপজ্জনক স্ট্রাইকারদের মধ্যে একজন। তাকে সবাই চিনতো তার অসাধারণ গতি, অনবদ্য ভারসাম্য এবং গোলের সামনে তার দূর্দান্ত বিচক্ষণতার জন্য। সেগুলির উপর ভর করেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন লিভারপুলের একজন লিজেন্ড এবং তাদের জন্য করেছিলেন অসংখ্য অসংখ্য গোল। এরপর তাকে চেলসি কিনে নেয় ৫০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে, যা ছিল সে সময়ে প্রিমিয়ার লীগের রেকর্ড ট্রান্সফার ফি।
তবে, দল বদলের এই তোপটি একদমই ঠিক স্থানে আঘাত হানতে পারেনি। ফার্নান্দো তোরেস তার অধারাবাহিক এবং অপর্যাপ্ত সব পারফর্মেন্স এর কারণে প্রথমে চেলসি’র বেঞ্চে জায়গা করে নেন, এবং তারপর আস্তে আস্তে তাকে দল থেকেই বের করে দেওয়া হয়, অর্থাৎ তিন দল ছাড়েন।
২০০৮ সালের উয়েফা ইউরো প্রতিযোগিতায় গোল্ডেন বুট জেতা এই স্প্যানিশ গোলস্কোরার চেলসিতে খুবই দূর্বিসহ কয়েকটি মৌসুম কাটিয়েছেন। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে তার অতি উচ্চ ট্রান্সফার ফি’টিকে, যার কারণে তার ঘাড়ে চেপেছিল অসম্ভব রকমের প্রত্যাশার চাপ। আবার অনেকে এটিও মনে করেন যে, তার ব্যর্থতার জন্য দায়ী হল বহুদিন ব্যাপী চলমান চেলসি’র “নাম্বার ৯” অভিশাপটি।
৮. আন্দ্রে শেভচেঙ্কো (এসি মিলান থেকে চেলসি) [8. Andrei Shevchenko (AC Milan to Chelsea)]
সাবেক এই ব্যালন ডি’অর জয়ী ইউক্রেনিয়ান ফুটবলার ৩০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ইতালিয়ান জায়ান্টস এসি মিলান হতে স্ট্যাম্ফোর্ড ব্রিজে পাড়ি জমান। সে সময়ে তার ট্রান্সফার ফি’টিকে চেলসি’র পক্ষ থেকে একটি শুভ বিনিয়োগ হিসেবেই ধরা হয়েছিল। এর আগে ইতালির মিলান শহরে এই স্ট্রাইকার বেশ কিছু দূর্দান্ত মৌসুম কাটিয়েছিলেন। এসি মিলানের হয়ে সিরি আ এবং চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতার পাশাপাশি তিনি সান সিরোতে বহু গোলের রেকর্ড ভেঙেছিলেন এবং প্রচুর ব্যক্তিগত পুরষ্কারও জিতেছিলেন।
চেলসি’র তৎকালীন বিলিয়নিয়ার রাশিয়ান মালিক রোমান আব্রামোভিচ তখন ক্লাবটিতে তৈরি করছিলেন একটি তারকার মেলা, যার উপর ভর করে তিনি চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতার স্বপ্ন দেখছিলেন, আর সেজন্যই তিনি দলটির পেছনে বেধরক খরচও করে যাচ্ছিলেন।
যদিও তার সেই বিনিয়োগের মিঠা ফল তিনি শীঘ্রই খেতে পেরেছিলেন, তবে বহু খেলোয়াড়ই ক্লাবটিতে এসে মানিয়ে নিতে পারেননি, এবং প্রত্যাশার চাপে নুইয়ে পড়ে ক্লাব ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বর্তমানে ইউক্রেন এর জাতীয় ফুটবল দলের কোচ, আন্দ্রে শেভচেঙ্কো। চেলসিতে তার ভাগ্য তোরেস বা মোরাতা’দের মত খারাপ না হলেও, চেলসির জার্সি গায়ে তিনি তার নামের প্রতি বিচার করতে পুরোপুরিভাবেই ব্যর্থ হয়েছিলেন, এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই।
৭. ড্যানি ড্রিংকওয়াটার (লেস্টার সিটি থেকে চেলসি) [7. Danny Drinkwater (Leicester City to Chelsea)]
যখন লেস্টার সিটি ২০১৫/১৬ মৌসুমে আকষ্মিকভাবে প্রিমিয়ার লীগের শিরোপা জিতে নিয়েছিল, তখন অনেক ফুটবল বোদ্ধারাই এটি প্রেডিক্ট করেছিলেন যে, তার ঠিক পরের ট্রান্সফার উইন্ডোতেই তাদের দল থেকে বেশ কিছু ভালো ভালো খেলোয়াড় বিদায় নিবেন।
কিছুদিনের মধ্যেই সেই প্রেডিকশনটি খুবই ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে, কারণ চেলসি’র মত একটি ধনী ও নামীদামী ক্লাব এসে তাদের (লেস্টারের) প্রিমিয়ার লীগ জয়ের দু’জন অবিসংবাদী নায়ককে কিনে নেয়। সেই দুইজন খেলোয়াড় হলেন এনগোলো কান্তে এবং ড্যানি ড্রিংকওয়াটার।
এনগোলো কান্তে এখন একজন চেলসি কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেলেও, ড্যানি ড্রিংকওয়াটার কিন্তু ক্লাবটিতে মোটেও সুবিধা করে নিতে পারেননি। ইঞ্জুরি এবং বাজে পারফর্মেন্সের কারণে তাকে চেলসি’র রিজার্ভ টিমের হয়েও খেলতে হয়েছে। ৩৫ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে কেনা এই খেলোয়াড় মূলত চেলসি’র তেমন কোন কাজেই আসেননি, বরং হয়ে উঠেছিলেন একটি বোঝা মাত্র।
৬. তিমুয়্যে বাকাইয়োকো (এএস মোনাকো থেকে চেলসি) [6. Tiemeue Bakayoko (AS Monaco to Chelsea)]
লেস্টার সিটি’র প্রিমিয়ার লীগ জেতার সাথে বেশ খানিকটা সাদৃশ্য রেখে সেবছর এএস মোনাকো পিএসজি’কে পেছনে ফেলে জিতে নিয়েছিল ফরাসি লিগা উন এর শিরোপা। প্যারিস সেইন্ট জার্মেই (পিএসজি) এর শক্তিমত্তা এবং আর্থিক সক্ষমতার দিকে তাকালে এএস মোনাকোর মত ক্লাবের লিগা উন শিরোপা জেতার বিষয়টিতে যে কেউই অবাক হবে। তাই সেটি তাদের জন্য ছিল বিশাল বড় একটি অর্জন।
তবে লেস্টারের মত এই মোনাকো দলটির উপরেও তখন বড় বড় ক্লাবগুলির নজর পড়তে শুরু হয়েছিল। লিওনার্দো জার্দিম এর ভয়ঙ্কর সেই মোনাকো দলের মিডফিল্ড এর কান্ডারি ছিলেন তিমুয়্যে বাকাইয়োকো। ২০১৭ সালে তিনি ৪০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে চেলসিতে যোগ দেন, এবং তার পরের বছরই তিনি একটি লোন চুক্তিতে এসি মিলানে পাড়ি জমান। মাঝখানের একটি বছরে তিনি বেশির ভাগ সময় ইঞ্জুরিতে তো কাটিয়েছেনই, তাছাড়া যতবারই খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন, চেলসি সমর্থকদের ঠিক ততবারই তিনি সম্পূর্ণরূপে হতাশ করেছিলেন।
৫. এন্ডি ক্যারোল (নিউক্যাসেল ইউনাইটেড থেকে লিভারপুল) [5. Andy Carroll (Newcastle United to Liverpool)]
নিউক্যাসেল ইউনাইটেডে অসংখ্য গোল করা লম্বা আকৃতির এবং দীর্ঘকেশি ফরোয়ার্ড এন্ডি ক্যারোলকে যখন বহু অর্থের বিনিময়ে লিভারপুল দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছিল, তখন তারা ভেবেছিল যে তারা একটি অসাধারণ চুক্তি সম্পন্ন করেছে। কিন্তু, চুক্তিটি সফল হওয়া তো দূরের কথা, এন্ডি ক্যারোল খুব তাড়াতাড়িই পরিণত হয়েছিলেন লিভারপুলের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতায়।
নিউক্যাসেল ইউনাইটেড এবং এমনকি পরবর্তীতে ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেডের হয়েও দূর্দান্ত গোলস্কোরিং ফর্মে থাকা এন্ডি ক্যারোল তার ক্যারিয়ারকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে এবং বিশ্ব ফুটবলের এলিটদের মধ্যে জায়গা করে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই লিভারপুলে যোগ দিয়েছিলেন। তবে, কেনি ডালগ্লিশের সেই হতাশাজনক লিভারপুল দলটির ব্যর্থতার পুরো ভার এসে তার ঘাড়েই পড়েছিল, যার জন্য অনেকেই মনে করেন যে, ৩৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাকে কেনাটা ছিল প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাসে লিভারপুলের সবচেয়ে বাজে সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে একটি।
৪. নিকোলাস পেপে (লি’ল থেকে আর্সেনাল) [4. Nicholas Pepe (Lille to Arsenal)]
এবার আসা যাক আর্সেনালের ক্লাব রেকর্ড সাইনিং নিকোলাস পেপে’র বিষয়টিতে। পেপে ছিলেন ফরাসি দল লি’ল এর একমাত্র উজ্জ্বল তারকা, যিনি তার দূর্দান্ত স্কিল মুভস এবং ড্রিব্লিং প্রতিভা দিয়ে সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন। এছাড়া তাকে আরিয়েন রোবেন বা রিয়াদ মাহরেজদের সাথেও তুলনা করা হচ্ছিল। এমন সময়ে আর্সেনাল ৭২ মিলিয়ন ইউরো নিয়ে হাজির হয় লি’ল এর দুয়ারে, এবং সাথে করে নিয়ে আসে নিকোলাস পেপেকে। বলাই বাহুল্য, বাঁকিটা আজ ইতিহাস! না, তিনি আর্সেনালকে সাফল্যের শিখরে নিতে পারেননি। তবে ক্লাবটির সমর্থকদের সম্পূর্ণরূপে হতাশ করার দিক থেকে তিনি বিশালভাবে সফল।
তাকে ফ্লপ বলার মূল কারণ এটি নয় যে তার মধ্যে কোন প্রতিভাই নেই। তার অসাধারণ প্রতিভার ঝলক তিনি মাঝে মধ্যেই দেখিয়েছেন, কিন্তু ধারাবাহিকতা হল তার প্রধান সমস্যা। ধারাবাহিকভাবে ভালো পারফর্ম করার ক্ষেত্রে তার জন্য মূল বাঁধা হল তার ইঞ্জুরি সমস্যা। এখন, যদিও তিনি আর্সেনাল দলে এখনও অবস্থান করছেন (মূলত তাদের সাবস্টিটিউট বেঞ্চে) এবং অদূর ভবিষ্যতে তিনি আমাদেরকে ভুলও প্রমাণিত করতে পারেন, তবুও তার প্রাইসট্যাগ এবং এখন পর্যন্ত পারফর্মেন্স এর উপর ভিত্তি করে তাকে ফ্লপ এর উপাধি না দিলেই নয়। এক একটি মৌসুম কেটে যাওয়ার সাথে সাথে তার মূল্যও কমছে, এবং সাথে সাথে কমছে আর্সেনাল দলে তার গেমটাইম।
৩. এলেক্সিস স্যাঞ্চেজ (আর্সেনাল থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) [3. Alexis Sanchez (Arsenal to Manchester United)]
তৎকালীন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ হোসে মোরিনহো ইংল্যান্ড জুড়ে ঝড় তুলে ফেলেছিলেন, যখন তিনি চিলিয়ান সুপারস্টার এলেক্সিস স্যাঞ্চেজকে দলে ভেড়ানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। স্যাঞ্চেজ তখন ছিলেন আর্সেনাল এর সাথে তার চুক্তির শেষ বছরে, এবং তাই তার পেছনে লেগে ছিল ইউরোপের সেরা সেরা বেশ কিছু ক্লাব, যার মধ্যে ইউনাইটেডের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যান সিটিও ছিল। তবে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডই শেষ পর্যন্ত তাকে দলে পাওয়ার লড়াইয়ে জিতে গিয়েছিল, এবং তাকে অনেক আড়ম্বরের সাথে আনভেইলও করেছিল। তাকে দিয়ে পিয়ানো বাজিয়ে তাকে স্বাগতম জানানোর সেই ভিডিওটির কথা ফুটবল সমর্থকরা কি এত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারেন?
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর সমর্থকরা আশা করেছিলেন যে এলেক্সিস স্যাঞ্চেজই হবেন সেই পথ প্রদর্শক, যাকে অনুসরণ করে এবং যার ঘাড়ে ভর করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাদের সাফল্যের দিনগুলি ফিরে পাবে। কিন্তু, তাদের সেই স্বপ্ন বা ভ্রম ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। ইউনাইটেড জার্সি গায়ে কাটানো তার প্রথম কয়েক মাসেই বোঝা গিয়েছিল যে ইঞ্জুরি এবং অধারাবাহিকতাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। তাকে কিনতে সরাসরি কোন টাকা খরচ করতে না হলেও, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তার বদলে আর্সেনালকে দিয়েছিল একজন ভয়ঙ্কর খেলোয়াড় — আলবেনিয়ান সুপারস্টার আনরিখ মাখিতেরিয়ান। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য স্বস্তির বিষয় হচ্ছে মাখিতেরিয়ানও আর্সেনালে গিয়ে একদমই সুবিধা করে নিতে পারেননি। উভয় খেলোয়াড়ই ছিলেন তাদের নতুন ক্লাবগুলির হয়ে ফ্লপ, তবে এলেক্সিস এর উপর প্রত্যাশা অনেকাংশেই বেশি ছিল, কারণ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মত সফল ও ঐতিহ্যবাহী ফুটবল ক্লাব সারা বিশ্বে খুব কমই আছে। ব্যর্থতার চাপ সামলাতে না পেরে এলেক্সিস শীঘ্রই ইন্টার মিলানে পাড়ি জমান।
২. এঞ্জেল ডি মারিয়া (রিয়াল মাদ্রিদ থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) [2. Angel Di Maria (Real Madrid to Manchester United)]
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে বেশ কয়েকবার করে লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা জেতার পর এঞ্জেল ডি মারিয়া ৫৭ মিলিয়ন ইউরোর একটি ডিলে ওল্ড ট্রাফোর্ডে পাড়ি জমান। আবারও, তিনি এমন একজন খেলোয়াড় ছিলেন, যার উপর ভর করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাদের সাফল্যের দিনগুলিতে ফিরতে চেয়েছিল। এবং তিনি তার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্যারিয়ারে নিজের প্রতিভার বেশ কিছু ঝলকও দেখিয়েছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল লেস্টার সিটি’র বিরুদ্ধে কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামে তার অনবদ্য কার্লিং ফিনিশটি।
কিন্তু, রিয়াল মাদ্রিদে থাকাকালীন তিনি যে পরিমাণে ধারাবাহিকতা এবং পারফর্মেন্স লেভেল প্রদর্শন করেছিলেন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে তিনি তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারেননি। সে কারণে, মাত্র একটি মৌসুম ইংল্যান্ডে কাটানোর পরেই তাকে পিএসজি’র কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
১. রমেলু লুকাকু (ইন্টার মিলান থেকে চেলসি) [1. Romelu Lukaku (Inter Milan to Chelsea)]
প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাসে এর চেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক কোন ট্রান্সফার বোধ হয় আর ঘটেনি। দীর্ঘকায় এই বেলজিয়ান স্ট্রাইকার যে একজন বিশ্বমানের খেলোয়াড় তা তিনি বার বারই প্রমাণ করেছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে ওয়েস্ট ব্রমউইচ এলবিয়ন ও এভারটনের হয়ে দূর্দান্ত খেলার পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে গিয়ে তেমন একটা সুবিধা করতে না পারলেও, এরপর ইন্টার মিলানে গিয়ে তিনি তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা দু’টি বছর কাটান, যার উপর ভিত্তি করেই মূলত চেলসি তাকে দলে ভেড়ায়।
চেলসি’র আক্রমণভাগকে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে টিমো ভার্নারের ব্যর্থতার ফল হিসেবেই ক্লাবটি লুকাকুকে কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে, তাকে দলে আনতে তাদের খরচ করতে হয় ৯৭ মিলিয়ন ইউরো। এত টাকা খরচ করাটা ছিল ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে একটি। চেলসি’র সমর্থকরা এবং স্বয়ং চেলসি’র কোচ থমাস টুখেলও মাঠের ভেতরে ও বাইরে লুকাকু’র আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাই, এখন যখন তিনি লোনে আবারও সেই ইন্টার মিলানেই ফিরে যাচ্ছেন, তখন চেলসি সমর্থকরা যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। তবে, চেলসি এই ডিলটির কারণে তাদের আর্থিক ক্ষতিটি কিভাবে পুষিয়ে উঠবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।