কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ ২০২২ শুরু হতে আর মাত্র ৩০ দিনেরও কম সময় বাকি, এবং টুর্নামেন্টটির গ্রুপ পর্যায় থেকে শুরু করে পুরো টুর্নামেন্টের জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পুরো পৃথিবীর ফুটবল প্রেমী জনগণ। সবারই প্রত্যাশা, এবারের বিশ্বকাপ আগের সব বারের চেয়ে ভিন্ন হবে, এবং আরও বেশি উত্তেজনাপূর্ণ হবে।
সবাই বিশ্বকাপের নক আউট পর্যায়ে নাটকীয়তা প্রত্যাশা করে থাকেন। তবে, গত কয়েকটি বিশকাপ আসরেই আমরা দেখেছি যে, নাটকীয়তা কিন্তু গ্রুপ পর্যায় থেকেই পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। এবং, এই নিবন্ধে আমারা সেরকম কিছু শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ নিয়েই কথা বলব, যেগুলিতে অঘটন ঘটার বা নাটকীয়তার সম্ভাবনা রয়েছে।
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের গ্রুপ পর্যায়ের ড্র অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে। সেসকল গ্রুপের মধ্যে কিছু কিছু আবার ডেথ গ্রুপ হিসেবেও আখ্যায়িত হয়েছে। সব মিলিয়ে, প্রতিবারের মতই এবারও বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ে এমন কিছু ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে, যেগুলির বিনোদন-চাহিদা অনেক বেশি। এবারের কাতার বিশ্বকাপ ২০২২ উপভোগের পাশাপাশি প্রতিযোগিতাটিকে পুঁজি করে অনেক ব্যাংক ব্যালেন্স তৈরি করে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বেটিং খেলোয়াড়েরাও (যারা খেলাধুলায় বেটিং করে থাকেন)।
তাহলে চলুন, দেখে নেওয়া যাক, আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচগুলির মধ্যে কোনগুলির দিকে পুরো বিশ্ব বেশি করে তাকিয়ে থাকবে।
গ্রুপ ডিঃ ফ্রান্স বনাম ডেনমার্ক (Group D: France Vs Denmark)
পূর্বে যেমন প্রতিটি বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনা বনাম নাইজেরিয়ার মধ্যকার ফিক্সচারটি চিরাচরিত একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছিল, ঠিক তেমনটিই ঘটে চলেছে গত কয়েকটি বিশ্বকাপে ফ্রান্স বনাম ডেনমার্কের ফিক্সচারটি নিয়ে। এ যেন অবশ্যম্ভাবী একটি ব্যাপার। এ নিয়ে তারা বিশ্বকাপ আসরের গ্রুপ পর্যায়ে চতুর্থ বারের মত মুখোমুখি হতে চলেছে, এবং ফ্রান্সের হেড কোচ দিদিয়ের দেশম নিশ্চয় এই ফিক্সচারটি খেলতে খেলতে বিরক্তপ্রায় হয়ে উঠেছেন।
তিবে, তিনি ফিক্সচারটি নিয়ে যেমনই অনুভব করুন না কেন, এই ডেনমার্ক দল যারা কি না গত বেশ কিছু বছর ধরেই তার দলকে পস্তিয়ে আসছে, তাদের বিরুদ্ধে ভালো একটি ফলাফল বের করে আনার সিংহভাগ দায়িত্বই কিন্তু তার ঘাড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে এই দুই দলের মধ্যকার বেশির ভাগ ম্যাচেই পরাজিত হয়েছে বর্তমানের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স।
তবে, এই ফিক্সচারটির সম্পূর্ণ ইতিহাসের দিকে তাকালে অবশ্য শেষ হাসিটা ফরাসিরাই হাসবেন, কারণ ১৯৭৩ সালের পর থেকে মোট ১৬ বার একে অপরের মুখোমুখি হয়ে ৮ বারই জয়ী হয়ে মাঠ ছাড়তে সক্ষম হয়েছে ফরাসিরা। বাকি ৮টি ম্যাচের মধ্যে তারা ৬টিতে পরাজিত হয়েছে, এবং বাকি দুইটি ম্যাচ হয়েছে ড্র।
দুই দলের জন্যই ম্যাচটি বেশ রোমাঞ্চকর হলেও, ডেনমার্কের জন্য এটি খুবই মজার একটি ম্যাচ হতে চলেছে। ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে শিরোপা জেতার দৌড়ে শুধুমাত্র এই ডেনমার্ক দলটিকেই হারাতে ব্যর্থ হয়েছিল ফ্রান্স। এছাড়া, আগামী ২৬ নভেম্বর স্টেডিয়াম ৯৭৪ এ অনুষ্ঠিতব্য এই ম্যাচটিতে ডেনমার্ককে আরো সাহস জোগাবে লা ব্লুস’দের বিপক্ষে তাদের সাম্প্রতিক রেকর্ড (গত চার বছরের মধ্যে)।
গ্রুপ বিঃ ইংল্যান্ড বনাম যুক্তরাষ্ট্র (Group B: England Vs United States)
খোলা চোখে দেখলে এবারের কাতার বিশকাপ ২০২২ এর এই গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচটিতে খুব সহজেই থ্রি লায়নস খ্যাত ইংল্যান্ড দলের একটি জয় প্রেডিক্ট করা যায়। তবে, এটিও আমাদের আমলে নিতে হবে যে, গত বেশ কিছু বছর ধরেই কনকাকাফ এলাকার বাইরেও বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষ জাতীয় ফুটবল দলের পারফর্মেন্স আগের থেকে অনেক ভালো হয়েছে। এছাড়া, বিশ্বকাপে প্রবেশের ঠিক কয়েক সপ্তাহ পূর্বেই নানা ধরণের ইঞ্জুরি সমস্যার কারণে ইংল্যান্ড দলটিতে কিছুটা টালমাটাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইংল্যান্ডের অসংখ্য প্রতিভাবান ও তারকা খেলোয়াড়দেরকে সংঘবদ্ধ করতে বা একটি পূর্ণাঙ্গ দল হিসেবে খেলাতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের হেড কোচ গ্যারেথ সাউথগেট। এবছরে খেলা তাদের বেশ কিছু ম্যাচে ইংল্যান্ড দলের সেসকল তারকা পারফর্মাররা কোনভাবেই নিজেদের ব্যক্তিগত প্রতিভাকে দলগত সাফল্যে রূপ দিতে পারছেন না, এবং কাতার বিশ্বকাপ ২০২২ শুরুর পূর্বে তারা নিজেদেরকে ঝালাই করে নেওয়ার বা দলগত স্পৃহা বাড়ানোর আর কোন সুযোগও পাবেন না।
আমেরিকানদের নিকট এটি একটি সূবর্ণ সুযোগ এটি প্রমাণ করার যে, বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে তারাও এখন ইংল্যান্ড বা যুক্তরাজ্যের থেকে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই।
এছাড়া, এই দু’টি দেশের মধ্যে সবসময়ই কিছুটা রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে থাকে, যা এবারের বিশ্বকাপ আসরটিকেও আরো রোমাঞ্চকর এবং প্রতিযোগিতাময় করে তুলবে। আগামী ২৫ নভেম্বর কাতারের আল রাইয়ান শহরের আল বাইত স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিতব্য এই ম্যাচটি তাই একটি উষ্ম ও উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করতে পারবে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে।
গ্রুপ সিঃ আর্জেন্টিনা বনাম মেক্সিকো (Group C: Argentina Vs Mexico)
দক্ষিণ আমেরিকায় হয়তো ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচটিকে ক্লাসিকো বলে আখ্যায়িত করা হয়, তবে পুরো আমেরিকা (উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা) মিলিয়ে যদি কোন ক্লাসিকো থেকে থাকে, তাহলে সেটি হল আর্জেন্টিনা বনাম মেক্সিকো’র ফিক্সচারটি। উভয় দলই বেশির ভাগ সময়ই তাদের নিজ নিজ মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট এর শিখরে অবস্থান করেছে, এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে তাদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে সফল দু’টি দল হিসেবেই চিহ্নিত করা হবে, সে ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই।
যখনই কাতার বিশ্বকাপ ২০২২ এর গ্রুপ পর্যায়ের ড্র’তে এই দু’টি দল একই গ্রুপে পড়েছিল, তখন থেকেই এই ম্যাচটি উপভোগ করার জন্য ফুটবল প্রেমীরা উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছেন।
এই দুই দল সর্বপ্রথম মুখোমুখি হয়েছিল ১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রথম ফিফা বিশ্বকাপে, যা উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এবনহ যেটিতে চ্যাম্পিয়ন এর খেতাবটিও অর্জন করেছিল উরুগুয়েই। মেক্সিকোর বিপক্ষে সেই ম্যাচটিতে অবশ্য আর্জেন্টিনা জয়লাভ করেছিল। তারপর থেকেই এই ফিক্সচারটি উভয় দেশের ফুটবল অনুরাগী দর্শকদের জন্যই বেশ রোমাঞ্চকর একটি ফিক্সচারে পরিণত হয়েছে। এই দুই দল এ পর্যন্ত মোট ৩৫ বার একে অপরের মুখোমুখি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও যখন তারা একে অপরের সম্মুখীন হয়, ঠিক একইভাবে তারা উত্তেজনা ও উন্মাদনায় মেতে ওঠে, তেমনিভাবে যেভাবে তারা সেই প্রথম ম্যাচটিতে মেতেছিল।
এল ত্রি খ্যাত মেক্সিকো অবশ্য এই ফিক্সচারটিতে কিছুটা পিছিয়েই রয়েছে বলতে হবে, কারণ আলবিসেলিস্তে খ্যাত আর্জেন্টিনার বিপক্ষে খেলা তাদের ৩৫টি ম্যাচের মধ্যে তারা ১৬টিতেই হেরেছে (১৪টি ড্র, ৫টি জয়)। এছাড়া, মেক্সিকোর মাটিতেই আর্জেন্টিনা তাদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপাটি জিতেছিল। আগামী ২৬ই নভেম্বর কাতারের লুসেইল স্টেডিয়ামে তাই তারা মরণপণ চেষ্টা করবে ক্লাসিফিকাতোরিয়াস খ্যাত এই ম্যাচটিতে তাদের আদিম চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করে একটি অঘটনের জন্ম দিতে।
গ্রুপ জিঃ ব্রাজিল বনাম সুইজারল্যান্ড (Group G: Brazil Vs Switzerland)
ফিফা কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ বিশ্ব র্যাংকিয়ে বিশ্বের ১ নম্বর দল এবং ১৫তম দলের মধ্যকার বিশ্বকাপ ২০২২ এর গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচটি কাগজে কলমে খুব বেশি উত্তেজনার উদ্রেক হয়তো করবে না, কিন্তু এই ম্যাচটিকে ঘিরে বেশ পুরনো ইতিহাস রয়েছে।
প্রথমত, এটি স্বীকার না করলেই নয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে সুইজারল্যান্ডকে হারাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে ৫ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে। সাম্বা ফুটবলের জনক ব্রাজিলের সবচেয়ে ভালো ভালো দলগুলিও এই ইউরোপিয়ান দলটিকে ১ গোলের বেশি ব্যবধানে হারাতে হিমসিম খেয়েছে, এবং অনেক বার তো তারা ব্রাজিলকে জিততেও দেয়নি। এ পর্যন্ত ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ৯টি ম্যাচ খেলে তার মধ্যে ৪টিতেই ড্র করতে সক্ষম হয়েছে সুইস’রা। আর, বাকি ৫টি ম্যাচের মধ্যে ৩টিতে জিতেছে ব্রাজিল, এবং ২টিতে সুইজারল্যান্ড।
সর্বশেষ তারা মুখোমুখি হয়েছিল ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত রাশিয়া বিশ্বকাপে। সেই ম্যাচটিতে নেইমারের ডাইভিং সমালোচনার কারণে বেশ কাদা ছোঁড়াছুড়ি এবং মারামারিও হয়েছিল। ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ড্র হয়েছিল, তবে সুইস’রা সেই ফলাফলটি নিয়েও খুব একটা খুশি ছিলেন না, কারণ তারা মনে করেন যে, নেইমার ম্যাচটিতে অতিরিক্ত অভিনয় করে খেলার তালমিল নষ্ট না করলে তারা ম্যাচটি জিতেও নিতে পারতেন।
আগামী ২৮ই নভেম্বর স্টেডিয়াম ৯৭৪ এ যখন কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে এই দুই দল আবারও মুখোমুখি হবে, তখন উভয় দলই নিজ নিজ কারণে চাইবে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করতে, এবং প্রমাণ করতে যে তারাই সেরা। এছাড়া, হয়তো এই ম্যাচটির মধ্য দিয়েই এটি নির্ধারিত হবে যে, গ্রুপ জি এর শীর্ষে থেকে কোন দল নক আউট পর্যায়ে অগ্রসর হতে পারবে।
গ্রুপ এইচঃ উরুগুয়ে বনাম ঘানা (Group H: Uruguay Vs Ghana)
ঘানার সামনে এবার উরুগুয়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার একটি সূবর্ণ সুযোগ অপেক্ষা করছে। উরুগুয়ের কারণেই তারা দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০১০ সালের ফিফা বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয়েছিল। ম্যাচের একদম শেষ পর্যায়ে ঘানার আসামোয়া জিয়ান এর করা একটি গোলমুখী শটকে হাত দিয়ে আটকান উরুগুয়ের তারকা স্ট্রাইকার লুইস সুয়ারেজ। বিনিময়ে তিনি লাল কার্ড দেখেন, এবং ঘানা একটি পেনাল্টিও পায়, কিন্তু ঘটনাক্রমে সেই পেনাল্টিটি ঐ আসামোয়া জিয়ানই মিস করেন, এবং খেলাটি টাই ব্রেকারে গেলে সেখানে তারা মুখ থুবড়ে পড়ে, এবং উরুগুয়ে ম্যাচটি জিতে নিয়ে সেমি ফাইনালে অগ্রসর হয়।
এবার অবশ্য কাগজে কলমে ঘানার থেকে অনেক ভালো একটি স্কোয়াড নিয়েই বিশ্বকাপে প্রবেশ করতে যাচ্ছে উরুগুয়ে। তবে, আমাদের এটিও মনে রাখতে হবে যে, একটি ম্যাচ যখন কোন একটি দলের জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিশোধমূলক হয়ে থাকে, তখন শক্তিমত্তা কোনই মাইনে রাখে না। এই গ্রুপটিতে যদি কোন একটি ম্যাচে অঘটন ঘটার সম্ভাবনা থেকে থাকে, তবে এটিই হল সেই ম্যাচটি।
উরুগুয়ে খুব ভালো করেই জানে এবারের বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচটিতে কোন সেন্টিমেন্ট বা মানসিকতা নিয়ে ঘানাইয়ান’রা তাদের উপর আছড়ে পড়বে। তাই, তারা আগামী ২রা ডিসেম্বর কাতারের আল জানুব স্টেডিয়ামে নিজেদের সকল অস্ত্রসস্ত্রসহ প্রস্তুত থাকবে।