যখন খবর ছড়িয়েছিল যে আর্লিং হাল্যান্ড ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দিতে যাচ্ছেন, তখন সকলের মনেই একপ্রকার ভয়ের সঞ্চার হয়েছিল।
২২ বছর বয়সী এই নরওয়েজিয়ান তারকা ফরোয়ার্ড সিটিতে যোগ দেওয়ার আগেই তার বিভিন্ন ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে লীগ ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রচুর গোল করেছেন, যদিও সেসকল লীগ ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলিকে অনেকেই নানা আবেগজনিত কারণে ছোট করে দেখে থাকেন। কিন্তু, সেসকল (তুলনামূলকভাবে) ছোট প্রতিযোগিতাগুলিতেও তার পারফর্মেন্স ছিল যে কারো নজরে পড়ার মত।
আর তারপরই তিনি যোগ দিলেন ইংলিশ চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটিতে, যে দলটির কোচ হলেন পেপ গার্দিওলা, যাকে কি না আধুনিক ক্লাব ফুটবলের শ্রেষ্ঠ কোচ হিসেবে গণ্য করা হয়। সম্পূর্ণ ফুটবল দুনিয়ার হুলিয়া বদলে দেওয়া এক কোচ, এবং গোলের সামনে মারাত্মক ক্ষমতাধারী এক যুবা খেলোয়াড় একসাথে কাজ করতে চলেছেন — এই বিষয়টি চিন্তা করেই অন্যান্য অনেক ক্লাবের কোচ ও খেলোয়াড়েরা ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছিলেন।
এবং, সকল প্রতিযোগিতায় মাত্র ২২টি ম্যাচ খেলে ইতিমধ্যে ২৭টি গোল করে তাদের সেসকল ভয়কে বাস্তবে পরিণত করেছেন আর্লিং হাল্যান্ড।
ম্যান সিটি ও নরওয়ের আইকনিক সাবেক মিডফিল্ডার আলফি হাল্যান্ডের সুপুত্র এভাবেই তার নিন্দুকদের মুখে চপেটাঘাত মেরেছেন। চলুন, তার অসাধারণ গোলস্কোরিং রেকর্ডটির দিকে একটু চোখ বুলানো যাক।
হাইলাইটস (Highlights)
- এবারের মৌসুমে হাল্যান্ড কতগুলি গোল করেছেন?
- ২০২২-২৩ মৌসুমের আগ পর্যন্ত প্রিমিয়ার লীগের গোলস্কোরিং রেকর্ডস
- সব মিলিয়ে আর্লিং হাল্যান্ড তার ক্যারিয়ারে কতগুলি গোল করেছেন?
- গত মৌসুমে (২০২১-২২) হাল্যান্ড কতগুলি গোল করেছিলেন?
এবারের মৌসুমে হাল্যান্ড কতগুলি গোল করেছেন? (How many goals has Haaland scored this season?)
যেমনটি আমরা আগেই বলেছি, এই নিবন্ধটি লেখার সময় পর্যন্ত আর্লিং হাল্যান্ড এবারের মৌসুমে সকল প্রতিযোগিতায় ম্যান সিটি’র হয়ে মোট ২২টি ম্যাচ খেলে ২৭টি গোল করে ফেলেছেন।
তবে, চলতি মৌসুমে ম্যান সিটি সকল প্রতিযোগিতায় মোট ২৬টি ম্যাচ খেলেছে। অর্থাৎ আর্লিং হাল্যান্ড এই মৌসুমে ইতিমধ্যে কমপক্ষে ৪টি ম্যাচে খেলতে পারেননি, যার পেছনে বিভিন্ন কারণ ছিল, যেমন হালকা চোট নিয়ে মাঠের বাইরে থাকা, পেপ গার্দিওলা’র রোটেশন পলিসি ইত্যাদি। তবে, তারপরও তার পরিসংখ্যান ইউরোপের যেকোন লীগের যেকোন খেলোয়াড়ের চেয়ে শ্রেয়, তাও আবার বিশাল ব্যবধানে।
শুধুমাত্র প্রিমিয়ার লীগেই হাল্যান্ড মাত্র ১৬টি ম্যাচ খেলে ২১টি গোল করে ফেলেছেন (নিবন্ধটি লেখার সময় পর্যন্ত)। আপনি যদি ভুলে গিয়ে থাকেন, তাহলে লীগ মৌসুমে এখনো বাকি রয়েছে ২১টি করে ম্যাচ। কেউ যদি তার মাঠের খেলা নাও দেখে থাকেন, শুধুমাত্র তার এই গোলস্কোরিং পরিসংখ্যানগুলি দেখে তিনিও বলে দিতে পারবেন যে, প্রিমিয়ার লীগ মৌসুমের এই পর্যায়ে এসে এমন পারফর্মেন্স সত্যিই বিষ্ময়কর।
তার কৃতিত্বটি আরো ভালোভাবে বোঝার লক্ষ্যে, চলুন দেখে নেওয়া যাক গত কয়েক বছরে কতগুলি করে গোল করে কারা কারা যথাক্রমে প্রিমিয়ার লীগ ও ইউরোপীয় গোল্ডেন বুট জিতেছেন।
প্রিমিয়ার লীগ গোল্ডেন বুট (২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত)
- ২০১৮ — মোহাম্মদ সালাহ্ (৩৮ ম্যাচে ৩২ গোল)
- ২০১৯ — মোহাম্মদ সালাহ্ (৩৮ ম্যাচে ২২ গোল), পিয়ের এমেরিক অবামেয়াং (৩৬ ম্যাচে ২২ গোল), সাদিও মানে (৩৬ ম্যাচে ২২ গোল)
- ২০২০ — জেমি ভার্ডি (৩৫ ম্যাচে ২৩ গোল)
- ২০২১ — হ্যারি কেইন (৩৫ ম্যাচে ২২ গোল)
- ২০২২ — মোহাম্মদ সালাহ্ (৩৫ ম্যাচে ২৩ গোল), হিউন মিং সন (৩৫ ম্যাচে ২৩ গোল)
ইউরোপীয় গোল্ডেন বুট (২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত)
- ২০১৮ — লিওনেল মেসি (৩৪টি গোল)
- ২০১৯ — লিওনেল মেসি (৩৬টি গোল)
- ২০২০ — চিরো ইম্মোবিলে (৩৬টি গোল)
- ২০২১ — রবার্ট লেভানডফস্কি (৪১টি গোল)
- ২০২২ — রবার্ট লেভানডফস্কি (৩৫টি গোল)
গাণিতিকভাবে দেখলে, বর্তমান ফর্ম ও স্কোরিং রেট বজায় রাখলে, এবং বড় কোন ইঞ্জুরিতে আক্রান্ত না হলে, চলতি মৌসুমে আর্লিং হাল্যান্ড ৫০টি গোলের মাইলফলকও স্পর্শ করে ফেলতে পারেন, যার মধ্যে ৪০টির মত আসবে শুধুমাত্র প্রিমিয়ার লীগেই। তেমনটি হলে তিনি উপরে উল্লিখিত উভয় পুরষ্কারই জিতে নিতে পারবেন, এবং এক মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গোল করার রেকর্ডও গড়বেন।
প্রিমিয়ার লীগের গোলস্কোরিং সংক্রান্ত বিভিন্ন রেকর্ডস (Current Premier League goal scoring record)
আপনি যদি প্রিমিয়ার লীগের গোলস্কোরিং সংক্রান্ত বিভিন্ন রেকর্ডের বই বের করেন, তাহলে দেখতে পাবেন যে, সেটি অসংখ্য সাবেক তারকাদের নামে ঠাসা।
তবে, একটি নাম — থিয়েরি অঁরি — অবশ্য সেখানে আপনি একাধিকবার খুঁজে পাবেন। প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বার গোল্ডেন বুট পুরষ্কারটি জিতেছেন তিনি।
তবে, সাবেক এই আর্সেনাল ও ফ্রান্স স্ট্রাইকারের দূর্দান্ত ধারাবাহিকতা, এবং গোলের সামনে অসামান্য ক্ষমতা থাকার পরও তিনি তার ক্যারিয়ারে কেবলমাত্র একবারই প্রিমিয়ার লীগে ৩০ গোলের মাইলফলকটি ছুঁতে পেরেছিলেন।
প্রিমিয়ার লীগ যুগে ৩০ গোলের মাইলফলক ছোঁয়া প্রথম খেলোয়াড় হলেন এন্ডি কোল। ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ৩৪টি গোল করেছিলেন। তার ঠিক পরের মৌসুমেই সমান সংখ্যক গোল করেছিলেন এলান শেয়ারার, যখন তিনি ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের হয়ে খেলতেন। তারপর থেকে সেই রেকর্ডটির কাছাকাছি যেতে পেরেছেন শুধুমাত্র মোহাম্মদ সালাহ্ই, যখন এই মিশরীয় জাদুকর লিভারপুলের হয়ে তার অভিষেক মৌসুমে ৩২টি গোল করেছিলেন।
তারপর থেকে মোহাম্মদ সালাহ্ আরো দুইটি প্রিমিয়ার লীগ গোল্ডেন বুট পুরষ্কার জিতেছেন, যদিও সেগুলি তাকে পিয়ের এমেরিক অবামেয়াং, সাদিও মানে, এবং হিউন মিং সন’দের সাথে ভাগাভাগি করতে হয়েছে। এছাড়া, রেডস’দের হয়ে নিজের প্রথম মৌসুমের পর থেকে সালাহ্ আর প্রিমিয়ার লীগে ২৫ গোলের মাইলফলকটিও স্পর্শ করতে পারেননি।
এরপর এসেছেন এক অদ্ভুতুড়ে হাল্যান্ড, যিনি কি না মৌসুমের অর্ধেক শেষ হওয়ার আগেই ২০ গোলের কোঠা পূরণ করে ফেলেছেন, এবং ২১ গোলে পৌঁছে গিয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে তিনি সহজেই ৪০ গোলের মাইলফলকটি ছুঁয়ে ফেলতে পারবেন, এবং এন্ডি কোল, এলান শেয়ারার ও মোহাম্মদ সালাহ্দের রেকর্ডগুলিকে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারবেন বলেই ধারণা করা যাচ্ছে।
গত মৌসুমে (২০২১-২২) আর্লিং হাল্যান্ড কতগুলি গোল করেছিলেন? (How many goals did Haaland score last season in 2021/2022?)
যখন থেকে হাল্যান্ড লাইমলাইটে আসতে শুরু করেছেন, তখন থেকেই তিনি ধীরে ধীরে তার এই অতিমানবীয় শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে শুরু করেছেন।
গত আড়াই বছরে তিনি আরো অনেক বেশি ফুটবল খেলতে পারতেন, এবং আরো অনেক বেশি গোলও করতে পারতেন, যদি না তিনি ঘন ঘন ইঞ্জুরিতে না পড়তেন। তবে, এত ইঞ্জুরি ও অন্যান্য বাঁধার পরেও তিনি প্রায় অসম্ভব সব গোলস্কোরিং পরিসংখ্যান অর্জন করেছেন।
তিনি তার সিনিয়র ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত যতগুলি ম্যাচ খেলেছেন, তাতে যদি তার গোল সংখ্যার গড় করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, তিনি গোলমুখে যতগুলি শট করেছেন, তার অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক বার তিনি গোল করেছেন। গত মৌসুম, যেটি ছিল বরুশিয়া ডর্টমুন্ড এর হয়ে তার সবশেষ মৌসুম, ছিল সেটির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ইঞ্জুরির কারণে গত মৌসুমে জার্মান ক্লাবটির হয়ে বহু ম্যাচ মিস করার পরেও তিনি বুন্দেসলিগায় ২৪ ম্যাচ খেলে ২২টি গোল করেছিলেন, এবং সকল প্রতিযোগিতায় ৩০ ম্যাচ খেলে ২৯টি গোল করেছিলেন।
তোর্জেগারকানোন বা জার্মান বুন্দেসলিগা’র গোল্ডেন বুট পুরষ্কারের লড়াইয়ে তিনি গত মৌসুমে তার সমকক্ষ ও বায়ার্ন মিউনিখের সাবেক স্ট্রাইকার রবার্ট লেভানডফস্কি’র নিকট হেরেছিলেন, কেবলমাত্র কম ম্যাচ খেলার অপরাধেই। গত মৌসুমে তার গোলের গড় দেখলেই বোঝা যায় যে, ইঞ্জুরিতে আক্রান্ত না হলে তিনি গত মৌসুমে জার্মান বুন্দেসলিগা ও ইউরোপ উভয় পর্যায়েই গোল্ডেন বুট পুরষ্কার জিতে নিতে পারতেন। এখন পর্যন্ত তার ক্যারিয়ারে সেই একটি ভিলেইনেরই উপস্থিতি রয়েছে, এবং সেটি হল ইঞ্জুরি।
গত মৌসুমের আগের মৌসুমে তিনি জার্মান বুন্দেসলিগায় ২৮টি ম্যাচ খেলে ২৭টি গোল করেছিলেন, এবং সকল প্রতিযোগিতায় ৪১টি ম্যাচ খেলে ৪১টি গোল করেছিলেন।
সব মিলিয়ে আর্লিং হাল্যান্ড তার ক্যারিয়ারে কতগুলি গোল করেছেন? (How many total goals does Haaland have overall?)
এরই মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের আজকের নিবন্ধটির শেষ অংশে পৌঁছে গিয়েছি। এই অংশের বিষয়বস্তু হল আর্লিং হাল্যান্ডের ক্যারিয়ার জুড়ে সর্বমোট গোলসংখ্যা।
হাল্যান্ড তার অদম্য প্রতিভার জোড়ে মাত্র ২২ বছর বয়সেই মোট ২০৩টি সিনিয়র এপিয়ারেন্স নিজের ঝুলিতে ভরে ফেলেছেন। যদি তিনি অন্তিত ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত খেলেন, তাহলে অতি সহজেই তার এপিয়ারেন্স এর সংখ্যা খুব সহজেই ৫০০ এর উপরে চলে যাবে। এমন এপিয়ারেন্স এর সংখ্যা অনেক লিজেন্ডরাও তাদের ক্যারিয়ারে সংগ্রহ করতে পারেন না। আর, তিনি যদি তার ক্যারিয়ারে এমন পরিমাণে ম্যাচ খেলতে পারেন, তাহলে তার ক্যারিয়ারের গোল ট্যালি কোথায় পৌঁছাতে পারে তা নিশ্চয় আপনারা সহজেই অনুধাবন করতে পারছেন।
তার গোলের সংখ্যা নিয়ে যখন কথা চলেই আসলো, তখন বলতেই হয় যে, এ পর্যন্ত অস্ট্রিয়ান বুন্দেসলিগা, জার্মান বুন্দেসলিগা, ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ এবং অন্যান্য ক্লাব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে তিনি তার ক্যারিয়ারে মোট ১৬১টি সিনিয়র গোল করতে পেরেছেন।
২০১৯ সালে নরওয়ে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক করার পর থেকে তিনি তার দেশের হয়ে মোট ২৩টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। এরই মধ্যে তিনি ২১টি আন্তর্জাতিক গোলের মালিকও হয়ে গিয়েছেন। এখন পর্যন্ত নরওয়ে জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা’র উপাধিটি রয়েছে হোর্গেন হুভে’র নিকটে, যার মোট গোল সংখ্যা ৩৩। তার থেকে হাল্যান্ড আর মাত্র ১২টি গোলের দূরত্বে অবস্থান করছেন।
আমাদের মতে, আর্লিং হাল্যান্ড ইতিমধ্যে এই প্রজন্মের সেরা গোলস্কোরারে পরিণত হয়ে গিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি প্রিমিয়ার লীগের মত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ লীগের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার দিকে সিদ্ধহস্তে এগুতেও শুরু করেছেন।
তিনি যতদিনে অবসরে যাবেন, ততদিনে হয়তো তিনি বিশ্ব ফুটবলের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতাতেও পরিণত হয়ে যেতে পারেন। তিনি এখন যেমনটি খেলছেন, এবং ভবিষ্যতে যেমন খেলা উপহার দিবেন, তার সবটুকু উপভোগ করতে পারাটাও আমাদের জন্য একটি সৌভাগ্যের বিষয়।