আর্সেনাল যখন ২০১৯ সালে তাদের ক্লাব রেকর্ড ফি ৭২ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে যুবা তারকা নিকোলাস পেপেকে কিনেছিল, তখন তা চারিদিকে বেশ সাড়া ফেলেছিল, এবং ক্লাবটি জুড়ে এই ট্রান্সফার নিয়ে বেশ ইতিবাচক পরিবেশও তৈরি হয়েছিল, বিশেষ করে তাদের সমর্থকদের মাঝে। ফরাসি দল লিল এর হয়ে তিনি তখন মাত্র আরেকটি অসাধারণ মৌসুম শেষ করেছিলেন, এবং আর্সেনালে এসে তিনি সরাসরি প্রথম একাদশে ঢুকে পড়বেন, এবং সাথে সাথেই তার ক্রীড়ানৈপূণ্যের মাধ্যমে মাঠের পর মাঠ মাতাবেন, এমনটিই আশা করেছিল আর্সেনাল ভক্তরাসহ প্রায় সকল ফুটবল বোদ্ধারাও। তারা আরো ভেবেছিল যে পেপেই আর্সেনালের আক্রমণভাগে সেই ধারটি জোগাবেন যার তাদের দলে বেশ কয়েক বছর ধরেই ঘাটতি ছিল।
শুরুতে তিনি তার প্রতিভার কিছুটা ঝলক দেখাতে সক্ষম হলেও ধীরে ধীরে তার পারফর্মেন্স এর মান কমতে থাকে, এবং আরো কিছুদিন পর তিনি এক অসীম হতাশার নামে পরিণত হোন। এক ধাক্কায় যদি বর্তমানে ফিরে আসা হয়, তাহলে দেখা যায় যে, ২উ বছর বয়সী নিকোলাস পেপে তার উপর রাখা সকলের আশা, ভরসা, প্রত্যাশা সবকিছু তো পুরোপুরিভাবে ভেঙেচুড়ে ছারখার করেছেনই, সাথে সাথে তার বিশাল বড় ট্রান্সফার ফি’র চাপটিও ঠিকমত সামলাতে পারেননি।
এই আইভোরিয়ান এখন আর্সেনাল দলের বেঞ্চেই বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে যাচ্ছেন, কারণ আর্সেনাল কোচ মিকেল আর্তেতা তাকে যথেষ্ট সুযোগ দিলেও তিনি নিজেকে প্রমাণ করতে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছেন বারংবার। নানা রিপোর্ট অনুসারে, এবারের ট্রান্সফার উইন্ডোতে নিকো পেপে আর্সেনাল ছাড়তে পারেন, কারণ গত মৌসুমে তিনি একদমই দলটির প্রথম একাদশে জায়গা করে নিতে পারেননি। অনেকেই বলতে পারেন যে, নিকোলাস পেপেই হলেন আর্সেনালের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সাইনিং। এ ব্যাপারে আমরা কোন মন্তব্য না করলেও এতটুকু আমরা বলতেই পারি যে, আইভরি কোস্টের এই তারকা ফুটবলার এমিরেটস স্টেডিয়ামে নিজেকে একদমই মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
কোন জায়গাটিতে ভুল হয়েছিল এই আইভোরিয়ান তারকার? কেন তিনি আর্সেনাল ফুটবল ক্লাবে কোন প্রকার ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে বার বার ব্যর্থ হয়েছেন? আসুন দেখে নেওয়া যাক নিকোলাস পেপের আর্সেনালে কাটানো বছরগুলির সংক্ষিপ্ত সারমর্ম, এবং জেনে নেওয়া যাক কেন ইংল্যান্ডে তিনি সফলকাম হতে পারেননি।
কেন আর্সেনালে এসে নিকোলাস পেপে কোনপ্রকার ইতিবাচক প্রভাবই ফেলতে পারেননি?
সত্যি বলতে, নিকোলাস পেপেকে যখন আর্সেনাল কিনতে চেয়েছিল, তখন ক্লাবটির অভ্যন্তরেই সেটিকে নিয়ে অনেক কানাঘুষো হয়েছিল। তখনকার আর্সেনাল কোচ উনাই এমারি চেয়েছিলেন পেপের স্বদেশী আরেক তারকা ক্রিস্টাল প্যালেসের উইল্ফ্রিড জাহাকে দলে নিতে, কিন্তু ক্লাবটির উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তারা তার বিপক্ষে গিয়েই পেপেকে কিনে নেয়। তখনকার আর্সেনালের হেড অফ ফুটবল, রাউল সানলেহি, পেপের ট্রান্সফারটির উপর অনেক বেশি জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গিয়েছে যে সেটির জন্যই তাকে তার চাকরি হারাতে হয়েছিল।
এই বিষয়টি যে উনাই এমারি পেপেকে দলে একদমই চাননি, পেপের আর্সেনাল ক্যারিয়ারের প্রথমেই পুরো ব্যাপারটিকে ঘোলাটে করে দিয়েছিল। যেহেতু তার ট্রান্সফার ফি ছিল অনেক বেশি এবং তিনি ছিলেন আর্সেনালের সর্বকালের ক্লাব রেকর্ড (ফি এর দিক থেকে) সাইনিং, তাই অতি স্বভাবসুলভভাবেই ইংলিশ মিডিয়া তার পেছনে লেগেছিল, এবং সেই মৌসুমটির শুরু থেকেই পুরো স্পটলাইট তার উপরেই রেখেছিল। এমন সকল উচ্চ মূল্যের সাইনিংদের সাথেই তারা এমনটি করে আসছেন চিরকাল।
কিন্তু মাঠের বাইরের সমস্যা দূরে রাখলে, মাঠে তার বাজে পারফর্মেন্সের কারণ পেপে নিজেই। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে তার ব্যর্থতার মূল কারণই হল তার লীগটির গতি এবং চাহিদার সাথে মানিয়ে নিতে না পারা।
ত্তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই পেপে আক্রমণভাগের বাম পার্শ্বে খেলে অভ্যস্ত। আর্সেনাল তাকে বেশির ভাগ সময় রাইট উইংগেই খেলতে হয়েছে, কিন্তু তিনি তার দূর্বল পা (ডান পা) ব্যবহারে একদমই অক্ষম হওয়াতে তার জন্য সেখানে খেলা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এটি খুবই পরিচিত এবং প্রেডিকটেবল হয়ে গিয়েছে যে, পেপে বল পেলেই বাম পাশে কাট-ইন করবেন, এবং বাম পায়ের একটি শট গোলমুখে ছুড়বেন। এটি প্রথম থেকেই তার খেলার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এভাবে অনেক খেলোয়াড়ই খেলেন, যেমন সাবেক চেলসি তারকা আরিয়েন রোবেন, ম্যান সিটি সুপারস্টার রিয়াদ মাহরেজ, লিভারপুল উইংগার মোহাম্মদ সালাহ্ প্রমুখ। কিন্তু তারা সুযোগ বুঝে প্রায়ই তাদের ডান পা ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের ফুল ব্যাকের আউটসাইডে গিয়েও ক্রস দিতে বা শট মারতে সক্ষম। কিন্তু, নিকোলাস পেপে তা করতে একদমই অক্ষম হওয়ায় তিনি হয়ে পড়েছেন অনেক বেশি প্রেডিকটেবল, যা তা ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।
এখানে বর্তমান আর্সেনাল ইয়াংস্টার বুকায়ো সাকা’র কথাও আমরা উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি। তিনিও পেপের মতই বাম পা এর খেলোয়াড় এবং একইভাবে তিনিও রাইট উইং দিয়েই আক্রমণ করে থাকেন। কিন্তু, তফাৎটা সেই সেখানেই। সাকা চাইলেই তার দূর্বল পা (ডান পা) ব্যবহার করে ক্রস বা শট নিতে পারেন, যা প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের জন্য ডিফেন্ড করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এ থেকেই বোঝা যায় এই ইয়াংস্টার কেন আর্সেনালের রাইট উইংগের পজিশনটি নিজের করে নিতে পেরেছেন, এবং কেন পেপে কেবল একজন স্কোয়াড রোটেশন প্লেয়ারে পরিণত হয়েছেন।
শেষ কবে এই আইভোরিয়ান উইংগার আর্সেনালের জন্য একটি ম্যাচে শুরু থেকে খেলেছিলেন তা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে গত বছরের অক্টোবর মাসে, যখন ক্রিস্টাল প্যালেসের বিরুদ্ধে তিনি একটি ম্যাচে শুরু করেছিলেন, তাও আবার যখন সাকা হালকা চোট নিয়ে মাঠের বাইরে ছিলেন।
পেপেকে নিয়ে সর্বশেষ কি কি ট্রান্সফার গুজব সামনে এসেছে?
গত মে মাসে, এবছরের গ্রীষ্মকালীন ট্রান্সফার উইন্ডো শুরুর মাত্র এক মাস আগে নিকোলাস পেপে তার এজেন্ট বদলিয়েছেন, যার মানে শুধু এই হতে পারে যে, এবং তা হল তিনি এখন আর্সেনাল ছাড়ার চিন্তা ভাবনা করছেন।
এমনকি মিকেল আর্তেতা’র ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নিকোলাস পেপের গুরুত্ব ও প্রয়োজন এতটাই কম যে, কোন প্রকার ট্রান্সফার ফি ছাড়াই যদি এই আইভোরিয়ানকে ছেড়ে দিতে হয় বা তার চুক্তিটি বিনাশ করতে হয়, তবে তাতেও গানারস’রা রাজি। তবে, আর্সেনাল চায় যেন তারা নিকোলাস পেপের বদলে কমপক্ষে ২৫-৩০ মিলিয়ন ইউরো পায়, যদিও তার বর্তমান চুক্তির মেয়াদ এখনো ২ বছর বাঁকি।
ফ্রান্সের লিগা উনই মনে হচ্ছে বর্তমানে নিকোলাস পেপের জন্য সেরা গন্তব্য। তিনি ইতিমধ্যে দু’টি অফার পেয়েও গিয়েছেন সেখান থেকে। তার মধ্যে একটি হল মার্সেই এর পক্ষ থেকে, এবং অন্যটি হল তার সাবেক দল লিল এর পক্ষ থেকে। তবে, উভয় দলেরই কষ্ট হবে তার বর্তমান সাপ্তাহিক বেতন তাকে দিতে, যা হল ১৪০,০০০ ইউরো।
একটি গুজব অবশ্য এমনও ছড়িয়েছে সম্প্রতি যে, ফরাসি চ্যাম্পিয়ন প্যারিস সেইন্ট জার্মেই পেপের জন্য একটি অফার করতে যাচ্ছে। যদিও এটি বোঝা খুব কঠিন নয় যে পেপে কেন এত বড় একটি ক্লাবের অফারে হ্যাঁ বলবেন, তবুও এটিও তাকে বুঝেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, পিএসজিতে গেলে তিনি আবারও গেম টাইমের অভাবে ভুগবেন এবং হয়তো শুধুমাত্র একজন ব্যাক আপ খেলোয়াড় হিসেবেই ব্যবহৃত হবেন।
তবে আর যাই হোক, আর্সেনালে থাকলেই তাকে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হবে বলেই মনে হচ্ছে, কারণ আর্সেনাল ম্যানচেস্টার সিটি থেকে গ্যাব্রিয়েল জেসুসকে কেনার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে এবং যদি এই চুক্তিটি বাস্তবেই চূড়ান্ত হয়, তাহলে নিকোলাস পেপে যাও একটু খেলার সুযোগ পেতেন, তাও হয়তো আর পাবেন না।
পেপে এবার আর্সেনাল ছাড়লে তা উভয় পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক হবে
যেহেতু নিকোলাস পেপের বর্তমান চুক্তির মেয়াদ আর মাত্র ২ বছর বাকি রয়েছে, সেহেতু আর্সেনালের জন্য এটিই শ্রেয় হবে যদি তাকে এখনই বিক্রি করে দিয়ে কিছু অর্থ কামানো যায়। আরেক বছর অপেক্ষা করলে তার চুক্তির আর মাত্র ১ বছর বাকি থাকবে, এবং তখন কেউই তাকে কোন ফি দিয়ে কিনতে চাইবেন না। যেহেতু তাকে বিক্রি করে লাভ করার আশা আর নেই, তাই অন্তত তাকে ফ্রিতে যেতে না দিয়ে তার জন্য একটি মোটামুটি অঙ্ক বাগিয়ে নিতে পারলে অবশ্যই তাই এখন আর্সেনালের জন্য লাভ হিসেবে গণ্য হবে।
এছাড়াও, যেহেতু এখন পেপের বয়স ২৭ বছর, তাই এখনি যদি তিনি অন্য ক্লাবে যোগ দেন, তাহলেও তার ক্যারিয়ারটি নতুন করে সাজানোর একটি সুযোগ তিনি পাবেন। কিন্ত, যদি তিনি আর্সেনালের সাথে তার করা চুক্তিটি শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান, তাহলে তার বয়স তখন হবে ৩০ বছর, এবং ক্যারিয়ারকে আবার ঠিক দিকে নেওয়ার সময়ই তিনি আর পাবেন না।
এখনি পেপেকে বিক্রি করতে পারলে এর মানে এটিও হবে যে, আর্সেনাল এই চলমান ট্রান্সফার উইন্ডোতে তাদের দলের বিভিন্ন জরুরি পজিশনে বিভিন্ন খেলোয়াড়দের সাইনিং করানোর জন্য আরো কিছু অর্থও পাবে। এছাড়া, যদি তারা চান তাহলে নিকোলাস পেপেকে ব্যবহার করে গানারস’রা অন্য কোন দলের সাথে খেলোয়াড় এক্সচেঞ্জ বা প্লেয়ার প্লাস ক্যাশ চুক্তিও করতে পারেন।
সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে সাবেক আর্সেনাল ফরোয়ার্ড কেভিন ক্যাম্পবেল এ প্রসঙ্গে বলেন যে নিকোলাস পেপে অন্য ক্লাবে ভলে গেলে তা তার নিজের জন্য এবং আর্সেনালের জন্য, অর্থাৎ উভয় পক্ষের জন্যই শ্রেয় হবে।
ফুটবল ইনসাইডারকে তিনি আরো বলেন, “এই ট্রান্সফারটি (নিকোলাস পেপে টু আর্সেনাল) একদমই কাজ করেনি। ব্যাপারটি এতটাই সহজ। এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই যে তিনি একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়। কিন্তু, আর্সেনালে আসার পির থেকে কোন কিছুই তার পক্ষে যায়নি।। এক কথায় ট্রান্সফারটি কাজই করেনি।”
“আমি গত বড়দিনের আগেই বলেছিলাম যে আগামী পাঁচ থেকে ছয় মাস নিকোলাস পেপের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে। সেই পাঁচ ছয় মাসই বলে দিবে যে আর্সেনালে তার কোন ভবিষ্যৎ আছে কি নেই। আর এখন ফলাফলা আমাদের চোখের সামনে। আর্সেনালে তার কোন ভবিষ্যৎ নেই।”
আর্সেনালে যোগ দেওয়ার পর থেকে নিকোলাস পেপে সকল প্রতিযোগিতায় সর্বমোট ১১২টি ম্যাচ খেলে মোট ২৭টি গোল এবং ২১টি এসিস্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে, ক্লাবটি থেকে এখন তার শুধুই বিদায় নেওয়ার অপেক্ষা, এবং তা এই ট্রান্সফার উইন্ডোতেই সম্পন্ন হয়েও যাবে বলেই মনে হচ্ছে।
আর্সেনাল সম্প্রতি লিডস ইউনাইটেডের ব্রাজিলিয়ান রাইট উইংগার রফিনিয়াকেও কেনার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আরেকজন রাইট উইংগারের জন্য এমন মরিয়া হয়ে লাগার ফলে আরো স্পষ্ট হয়েছে এই ব্যাপারটি যে, আর্সেনালে নিকোলাস পেপের জন্য আর কোন জায়গাই ফাঁকা নেই।
আইভোরিয়ান এই উইংগার এখনো একজন সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় হিসেবেই বিবেচিত হবেন। কিন্তু, নিজের ক্যারিয়ারের ভালো চাইলে তিনি অবশ্যই এবারের ট্রান্সফার মৌসুমে আর্সেনাল ছেড়ে অন্য কোন দলে যোগ দিবেন।