ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে কেন্দ্র করে বর্তমান ট্রান্সফার উইন্ডোতে যে খেলোয়াড়টির নাম বার বার সামনে আসছে তিনি আর কেউ নন, বরং এরিক তেন হাগ এর পুরনো সতীর্থ ডাচ মিডফিল্ডার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, যিনি বর্তমানে বার্সেলোনাতে খেলে থাকেন।
এমনটিই ধারণা করা যাচ্ছে যে, ক্লাবটির নতুন ম্যানেজার এরিক তেন হাগ এই ২৫ বছর বয়সী তারকাকে নিয়ে আবারো একসাথে কাজ করতে চাচ্ছেন, এবং ২০২২-২৩ মৌসুমকে সামনে রেখে তিনি যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দলটি তৈরি করছেন সেখানে ডি ইয়ংকেই কেন্দ্রবিন্দু বানাতে চাচ্ছেন। এর আগে যখন তারা একসাথে একই দলে কাজ করেছেন, তখন তারা আয়াক্স আমস্টারডামকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, যে সেই দলটিকে ২০১০ এর দশকের সেরা দলগুলির মধ্যে একটি ধরা হয়। এরপর ডি ইয়ং পাড়ি জমিয়েছিলেন তার স্বপ্নের ক্লাব বার্সেলোনায়।
নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের দু’জনের ক্যারিয়ার বর্তমানে রয়েছে দু’টি ভিন্ন পথে। ডি ইয়ং এর ক্যারিয়ার তার বর্তমান ক্লাবের মতই হিমসিম খাচ্ছে, আবার অপর দিকে তেন হাগের ক্যারিয়ার এখন একটি মোড় নিতে যাচ্ছে, তবে সেটি ভালোর দিকে না খারাপের দিকে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। কিছুটা সামনের দিকে যদি লক্ষ্য করা যায়, তবে এমনটিই মনে হয় যে এই পুনর্মিলনীটি বাস্তবে রূপ নিলে উভয় পক্ষই উপকৃত হবে। তবে, যেহেতু ডি ইয়ং বার বার এ ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছেন এবং বলছেন যে তিনি এখনো বার্সেলোনার খেলোয়াড় এবং সেদিকেই তিনি মনযোগ দিচ্ছেন, সেহেতু অন্য কোন সুযোগ্য খেলোয়াড়কে ব্যাক আপ অপশন হিসেবে রাখাটাও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এবং তেন হাগ এর জন্য উচিৎ কর্ম হবে বলেই মনে হচ্ছে।
এবং, এমন একজন বিকল্প খেলোয়াড় ঠিক তাদের চোখের সামনেই রয়েছেন — যদিও তিনি ডি ইয়ং এরও আগে থেকে খেলার জগতে পরিচিত — এবং তিনি হলেন লেস্টার সিটির মিডফিল্ডার, উইল্ফ্রিড এনদিদি।
এনদিদি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গল্প
নাইজেরিয়ান তারকা এনদিদিকে দলে নেওয়ার চেষ্টা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কয়েক মৌসুম ধরেই চালাচ্ছে, এবং বেশ কিছু ফুটবল পন্ডিত, যাদের মধ্যে ইউনাইটেড এর বিখ্যাত ১৯৯৮ ব্যাচেরও অনেকে রয়েছেন, বার বার বলেছেন যে এনদিদি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য একজন উপযুক্ত খেলোয়াড়।
গ্যারি নেভিল, যাকে সেই বিখ্যাত ব্যাচ থেকে আসা সেরা বোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম ধরা হয়, তিনিও ২০২১ সালে এমন মন্তব্যই করেছেন। ফক্সেস’দের তারকা স্ট্রাইকার জেমি ভার্ডি’র পাশাপাশি এই উইল্ফ্রিড এনদিদিকে দলে নিতে পারলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বেশ লাভবান হবে বলেই মন্তব্য করেছিলেন নেভিল।
এই মাসেরই শুরুর দিকে, স্কাই স্পোর্টসে কর্মরত ক্রিস হ্যামিল তার ইউটিউব চ্যানেল ফুটবল ডেইলি’তে বিভিন্ন পরিসংখ্যান দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে কেন এনদিদি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য একদম উপযুক্ত একজন খেলোয়াড়। তিনি বলেন, “লেস্টার সিটি’র তারকা নাইজেরিয়ান উইল্ফ্রিড এনদিদিই সেই খেলোয়াড় যাকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড হন্যে হয়ে খুঁজছে। এবং, যেহেতু লেস্টারের সাথে তার চুক্তির মেয়াদ আর মাত্র ২ বছর বাঁকি রয়েছে, সেহেতু পূর্বে তার যেমন আকাশচুম্বী মূল্য হাঁকানো হয়েছিল তেমন মূল্য কিন্তু লেস্টার বর্তমানে আর হাঁকাতে পারবে না।”
তিনি আরো বলেন, “এবং, যদিও তিনি একটি গুরুতর হাঁটুর ইঞ্জুরি নিয়ে গত মৌসুমের শেষ দুই মাস সাইডলাইনে কাটিয়েছেন, তবুও ফিট থাকাকালীন অবস্থায় তিনি এখনো বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিভাবান ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের মধ্যে একজন। গড়ে তিনি প্রতি খেলায় ৬.৫টি ট্যাকেল এবং ইন্টারসেপশন করে থাকেন, এবং এরিয়াল ডুয়েলের দিক থেকেও তিনি বিশ্বের শীর্ষ ৭% মিডফিল্ডারদের মধ্যে অবস্থান করছেন।”
ফুটবল বোদ্ধারা বেশ কয়েক বছর ধরেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং এনদিদি’র জুটি নিয়ে যে শুধু কথা বলাবলিই করেছেন এমন না, বরং গত কয়েক মৌসুমের বিভিন্ন পর্যায়ে ২০ বারের প্রিমিয়ার লীগ জয়ী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বেশ কয়েকবার এনদিদিকে দলে নেওয়ার জন্য ট্রান্সফার বিডও করেছেন বলে জানা গিয়েছে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভক্তদের কাছেও এই খেলোয়াড়টি বেশ পছন্দনীয়, যেমনটি তারা প্রায়ই জাহির করে এসেছেন বিভিন্ন পাব্লিক ফোরাম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলির কমেন্ট সেকশনে। তারা আসলেও মনে করেন যে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মিডফিল্ডে জীবন ফিরিয়ে আনতে হলে এনদিদি’র মত প্রাণবন্ত একজন খেলোয়াড়কেই তাদের দরকার।
তাহলে কেন বর্তমানে এই নাইজেরিয়ান তারকার পেছনে ছুটছে না ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড?
লেস্টার কর্তৃক স্থাপিত প্রাইস ট্যাগঃ এনদিদি’র জন্য ৫০ মিলিয়ন ইউরো
এমন একজন খেলোয়াড় যিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দলগত স্টাইল এবং রণকৌশলে একদম খাপে খাপ মিলে যান, তাকে দলে না নেওয়ার পেছনে একমাত্র কারণ হিসেবে যদি ক্লাবটি অর্থনৈতিক অক্ষমতাকে দর্শান, তাহলে আর বিতর্কের তেমন কোন অবকাশই আর থাকে না। তবে এমনটিই মনে হচ্ছে যে, এই অযৌক্তিক কারণেই রেড ডেভিলরা এই নাইজেরিয়ানকে আর দলে নিতে চাচ্ছেন না।
২০১৮ সালে — যখন উইল্ফ্রিড এনদিদি কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামে কেবল এক বছর পার করেছিলেন — নাইজেরিয়ান এই মিডফিল্ডার লেস্টারের সিটির সাথে ছয় বছরের একটি লম্বা চুক্তিতে আবদ্ধ হোন, যা তাকে ক্লাবটিতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ করে। তার জন্য যে মূল্যটি লেস্টার সিটি নির্ধারণ করেছে, তা অবশ্যই এমন একজন খেলোয়াড় এর জন্য উপযুক্ত, যিনি খেলোয়াড় হিসেবে তো অনবদ্য বটেই, তার উপর আবার যার সাথে ক্লাবটির একটি বড়সড় চুক্তিও রয়েছে। তবে, নিশ্চিতরূপেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাকে ৫০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে কেনার যোগ্য একজন খেলোয়াড় হিসেবে গণ্যই করে না।
অতএব, এরই ভিত্তিতে বলা যায় যে, প্রিমিয়ার লীগে একজন প্রমাণিত ও পরীক্ষিত খেলোয়াড় হওয়া সত্ত্বেও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এনদিদিকে একজন অনবদ্য খেলোয়াড় হিসেবে দেখতেই নারাজ। এটি তাদের ক্ষতি হিসেবেই চিহ্নিত হওয়ার সুযোগ বেশি, কারণ প্রিমিয়ার লীগের আরেক ক্লাব এস্টন ভিলা এবং তাদের ম্যানেজার সাবেক লিভারপুল তারকা স্টিভেন জেরার্ড এই ২৫ বছর বয়সীর জন্য একটি বিড তৈরি করছেন বলেই জানা গিয়েছে। এছাড়া তাকে দলে নেওয়ার দৌড়ে স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদও সামিল রয়েছে, তবে মনে হয় না আরেক মিডফিল্ডার মোনাকো’র অরেলিয়েঁ চুয়ামেনিকে ১০০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে দলে নেওয়ার পর তারা এনদিদি’র পেছনে আরো ৫০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবে।
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে হিমসিম খেতে থাকা বার্সেলোনা যে মিডফিল্ডারের জন্য ৭০ থেকে ৮০ মিলিয়ন ইউরো দাবি করে বসে আছে, সেই ডি ইয়ং ব্যতীতও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এমন অনেক মিডফিল্ডারদের সাথে লিঙ্কড যাদের বাজার মূল্য উইল্ফ্রিড এনদিদি’র বাজার মূল্যের চেয়েও অনেক গুণে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, তারা ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেডের তারকা মিডফিল্ডার ডেক্লান রাইসকে টার্গেট করেছেন বলে জানা যায়, যার বাজার মূল্য কি না ১৫০ মিলিয়ন ইউরো। তবে, এটি হলপ করে বলা যায় যে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য এখন এনদিদি’র মত একজন খেলোয়াড়কেই অধিক প্রয়োজন, কারণ তাদের দরকার এমন কাউকে যিনি প্রতিপক্ষের আক্রমণকে মিডফিল্ডেই রুখে দিতে সমর্থ্য হবেন, এবং একজন ডিস্ট্রোয়ার হিসেবে কাজ করবেন। তিনি যে ধরণের খেলোয়াড়, ঠিক তেমন একজনের অনুপস্থিতিই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে গত কয়েক মৌসুম ধরে ভোগাচ্ছে।
উইল্ফ্রিড এনদিদি বনাম ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং
এই দুই খেলোয়াড়ের মধ্যকার পার্থক্যগুলি শুধুমাত্র এই বিষয়টিই স্পষ্ট করবে যে, ডি ইয়ং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য কেবল নামেমাত্রই ভালো একটি সাইনিং হবেন, কিন্তু বর্তমানে ইউনাইটেড এর নিকট যে মূল একাদশটি রয়েছে, সেখানে তিনি তেমন কোন ইতিবাচক প্রভাবই ফেলতে পারবেন না।
ডি ইয়ং এমন একজন অনবদ্য মিডফিল্ডার, যিনি বলের উপর তার অসাধারণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অসামান্য শক্তিমত্তারও পরিচয় দিয়েছেন। যখন তিনি মিডফিল্ড দিয়ে অসীম গতিশীলতার সহিত ড্রিবলিং করে সামনে বেরিয়ে যান, তখন তাকে ধাওয়া করা বা তার কাছ থেকে বল কেড়ে নেওয়া খুবই কঠিন একটি কাজ। এছাড়া তিনি পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট বল ক্যারিয়ারদের মধ্যেও অন্যতম, এবং প্রতি ম্যাচে তিনি বক্স টু বক্স দৌড়াদৌড়ি করে প্রচুর গ্রাউন্ডও কভার করেন। এর বাইরেও তার রয়েছে অসাধারণ দূরদর্শীতা, যার কারণে তিনি তার মস্তিষ্কে খুবই জলদি বিভিন্ন পাসিং জোন প্রক্রিয়াজাত করে নিতে পারেন এবং নিজের হাফ থেকে প্রতিপক্ষের হাফে অসাধারণ সব লং-রেঞ্জ পাস প্রেরণ করতে পারেন।
খেলোয়াড় হিসেবে এনদিদি’র অসাধারণ গূণাবলির মধ্যে রয়েছে ট্যাকলিং, প্রেসিং, প্রতিপক্ষের ডিফেন্সকে স্ক্রিনিং করা, এবং খেলা বার বার রিস্টার্ট করানো ইত্যাদি। তার এসকল দিকগুলি বিশ্বের সকল নামকরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের মধ্যেই উপস্থিত। এছাড়াও, তিনি হলেন বর্তমান বিশ্বে মাত্র কয়েকজন খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন, যার কি না পজিশনাল জ্ঞান অনেক বেশি, এবং ঠিক এই জায়গাটিতেই ডি ইয়ং তার থেকে অনেকাংশে পিছিয়ে পড়েন। যেকোন ট্যাকল করার জন্য এই মহান ডাচ তারকাকে কোন এক দিকে কিছুটা হলেও আগাতে হয়। অপর দিকে, এনদিদিকে তার পজিশন থেকে দূরে তেমন একটা দেখাই যায় না, এবং সেই কারণেই তাকে বলের পেছনে তেমন একটা দৌড়াতেও দেখা যায় না।
এর ফলে এনদিদি ডি ইয়ং এর চেয়ে কম সময়েই খেলাটি পুনরায় চালু করতে সক্ষম হোন, কারণ বলটি কেড়ে নেওয়ার পর এনদিদি তার নিকট উপলব্ধ পাসগুলির দিকে এক নজর তাকিয়ে নেন, এরপর সামনের দিকে অর্থাৎ প্রতিপক্ষের অর্ধ্বে একদম মেপে মেপে বলটি পাঠিয়ে দেন। এ থেকে ব্রুনো ফার্নান্দেজ এবং ফ্রেড এর তো সুবিধা হবেই, পাশাপাশি জ্যাডোন স্যাঞ্চোসহ ম্যান ইউ এর সকল উইংগাররা যারা আক্রমণভাগে গিয়ে আবার ভেতরের দিকে কাট-ইন করে এগিয়ে যেতে পছন্দ করেন তারা সকলেই নানাবিধ সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পাবেন।
উপসংহার
উভয় মিডফিল্ডারেরই রয়েছে তাদের নিজস্ব কিছু বিশেষ গুণাবলি, এবং এমনটিও সম্ভব যে, হয়তো এরিক তেন হাগ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে একটি নতুন আয়াক্স দলই তৈরি করতে চলেছেন। এই কারণেই বলা যায় যে, ওল্ড ট্রাফোর্ডের এই ক্লাবটির জন্য এবং তাদের হেড কোচ তেন হাগ এর জন্য ডি ইয়ং খুবই উপযুক্ত একজন খেলোয়াড়।
কিন্তু, যেহেতু তাদের হাতে আর তেমন একটা সময় বা মূলধন বাঁকি নেই, এবং ক্লাবটির স্টকও একদমই নিম্নমুখী ঢালে অবস্থান করছে, সেহেতু উইল্ফ্রিড এনদিদিই হলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য সেরা বিকল্প, যার কি না প্রিমিয়ার লীগে বেশ কিছু বছর ধরে খেলার পূর্ণ অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এই বিষয়টিই ৫২ বছর বয়সী তেন হাগকে কিছুটা হলেও ভাবাবে। তবে এই দুই জনের মধ্যে যে খেলোয়াড়কেই তারা দলে টানুক না কেন, দলের ক্রীড়াকৌশল অনুসারে দেখতে গেলে উভয় খেলোয়াড়ই বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখন সময়ই বলে দিবে আপনারা কে কখন কোথায় থাকবেন বা চলে যাবেন।