প্রিমিয়ার লীগকে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট ফুটবল লীগ হিসেবে মান্য করার পেছনে একটি অন্যতম প্রধান কারণ রয়েছে। সেটি হচ্ছে এই লীগের প্রত্যেকটি দলের মধ্যকার অসামান্য প্রতিযোগিতা এবং ভক্তদের আশা ভরসার ফলে তৈরি হওয়া খেলোয়াড়দের উপরের চাপ। এই লীগের প্রত্যেকটি খেলাই হয় উত্তেজনায় ভরপুর এবং প্রত্যেকটি দলই বেশ গুণমানসম্পন্ন, যা পৃথিবী বা ইউরোপের অন্য কোন লীগেই তেমন একটা দেখতে পাওয়া যায় না।

প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাস থেকে একটি নিদর্শন পাওয়া যায়, এবং সেটি হল, সব খেলোয়াড় এই লীগে টিকতে পারেন না। অনেক বছর ধরেই আমরা দেখে আসছি যে, অনেক খেলোয়াড়ই এমন অন্য কোন দেশের লীগ থেকে এসে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে যোগ দেন সুন্দর ও সাবলীল ফুটবল খেলার এবং একটি শ্রেয় ক্যারিয়ার গড়ার উদ্দেশ্যে, কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেরই খেলার মান কমে যায় প্রিমিয়ার লীগে আসার পর, এবং তারা তাদের নিজেদের পুরনো রূপের ছায়া হয়েই থেকে যান। 

আজকের নিবন্ধে আমরা পড়ব এমন পাঁচজন ডিফেন্ডারদের নিয়ে যারা অনেক টাকার বিনিময়ে প্রিমিয়ার লীগে নাম লিখালেও সেখানে টিকতে পারেননি। কিন্তু, সে সম্পর্কে পড়ার আগে চলুন আমরা জেনে নিই কেন ডিফেন্ডারদের প্রিমিয়ার লীগে এসে বেশির ভাগ সময়ই মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়। চলুন শুরু করা যাকঃ

কেন প্রিমিয়ার লীগে ডিফেন্ডাররা ফ্লপ খান? (Why do defenders flop in the Premier League)

তরুণ হোক বা অভিজ্ঞ, যেকোন বয়সের প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের উপর প্রচুর অর্থ ব্যয় করার নজির প্রিমিয়ার লীগেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও বড় বড় লীগ থেকে আসা এসব খেলোয়াড়দেরকে শুরুতেই প্রিমিয়ার লীগের উচ্চ গতি এবং ইংল্যান্ডের ভেজা আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ভালোই বেগ পেতে হয়। বিশেষ করে প্রিমিয়ার লীগ খেলার শারিরিক ধাঁচের সাথে খাপ খাইয়ে নিতেই খেলোয়াড়দের বেশি সময় লেগে থাকে। এবং যখন সেই খেলোয়াড়টি হোন একজন ডিফেন্ডার বা রক্ষণভাগের খেলোয়াড়, তখন তার জন্য সেই চ্যালেঞ্জটি আরো বড় হয়ে দাঁড়ায়।

এমন প্রতিযোগিতামূলক লীগে ডিফেন্সের শেষ লাইনটি খুবই জরুরি একটি ভূমিকা পালন করে থাকে প্রত্যেক দলের জন্যই। প্রিমিয়ার লীগে সব খেলাই হয় অনেক উচ্চ গতিতে, এবং এই লীগে কোনকিছুরই কোন নিশ্চয়তা নেই, যা এই লীগটির সৌন্দর্য আরো বহুগূণে বাড়িয়ে দেয়। এখানে ডিফেন্ডাররা এক সেকেন্ডের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেলেও মুহূর্তের মধ্যেই তাদেরকে সেটির জন্য অনেক বড় মাশুল দিতে হয়।

প্রিমিয়ার লীগের এইসকল বৈশিষ্ট্যের কারণেই তরুণ বা অভিজ্ঞ সকল খেলোয়াড়দের জন্যই এই লীগে খেলা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। এখানে আমরা আপনাদের সামনে নিয়ে এসেছি এমন ৫ জন উদীয়মান ও প্রতিভাবান ফুটবলারদের একটি তালিকা যাদেরকে অনেক দাম দিয়ে কেনা হলেও তারা প্রিমিয়ার লীগে এসে তেমন কোনই ছাপ ছাড়তে পারেননি।

তাহলে, কারা হলেন প্রিমিয়ার লীগে ফ্লপ খাওয়া সবচেয়ে দামী কয়েকজন ডিফেন্ডার? চলুন জেনে নেওয়া যাকঃ

হ্যারি ম্যাগুয়াইয়ার – ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড (Harry Maguire – Manchester United)

সবার মুখে মুখে এই নামটি ইদানিং গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। প্রিমিয়ার লীগের বর্তমান ২০২১-২২ মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং বাজে পারফর্মেন্সের এমন গভীরতায় পৌঁছেছে যেখানে তারা আগে কোন মৌসুমেই তারা পৌঁছাননি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অধিনায়ক হিসেবে দুইটি খুবই অসন্তোষজনক মৌসুম কাটানোর পর এখন দেখার বিষয় হচ্ছে যে, তিনি নতুন কোচের পরিকল্পনার অধীনে আছেন কি না। কিন্তু, ফর্ম ফিরুক বা না ফিরুক, তাকে রাখা হোক বা বিক্রিই করে দেওয়া হোক, দর্শকদের মন জয় করতে পারুক আর নাই পারুক, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে হ্যারি ম্যাগুয়াইয়ার একজন প্রতিভাবান ডিফেন্ডার এবং একজন নিখুঁত ব্যক্তিত্ব।

কেমন ছিল সফর? (How it was)

হ্যারি ম্যাগুয়াইয়ারকে লেস্টার সিটি থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাদের থিয়েটার অব ড্রিমস এ নিয়ে এসেছিল ৮০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে! হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন, এই অসামান্য মূল্য তাকে করে তুলেছে বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে দামী ডিফেন্ডার।

এই দানবাকার মূল্যের কারণেই মূলত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভক্ত ও সমর্থকরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে হ্যারি ম্যাগুয়াইয়ারই তাদের সাম্প্রতিক খারাপ সময়ের অবসান ঘটাবেন এবং ক্লাবটিকে আবারও শিরোপাজয়ীদের কাতারে ফিরিয়ে আনতে পারবেন। এবং শুরুটাও হয়েছিল দারুণ। তার সুন্দর ক্রীড়ানৈপূণ্যের প্রদর্শণ দেখে রেড ডেভিলদের তখনকার ম্যানেজার, ওলে গানার সলস্কিয়ার, তাকে দলটির অধিনায়কত্বও প্রদান করেন। তার প্রতি ক্লাবের প্রত্যাশাও বেড়ে যায়। কিন্তু, ম্যাগুয়াইয়ার সেই অসীম আশা ভরসার চাপের নিচে আস্তে আস্তে দাবা পড়ে যেতে থাকেন। 

পড়ুন:  ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ বলের ইতিহাস

বর্তমান পরিস্থিতি (How it’s going)

প্রিমিয়ার লীগের ২০২০-২১ মৌসুমটি শুরু হওয়ার পর থেকেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অধিনায়কের খারাপ সময়ের সূচনা হয়। খেলার মাঠে তিনি নিয়মিত হারে বিভিন্ন প্রকারের ভুল করে বসতে থাকেন, এবং তার কার্যকারিতা দিন দিন বিশাল হারে কমতে থাকে। তিনি তার পূর্বের রূপের একটি ছায়া মাত্র হয়েই থেকে যান। ২০২১-২২ মৌসুম শুরু হতে না হতেই ম্যাগুয়াইয়ার এর পারফর্মেন্স আরেক ধাপ নিচে চলে যায়, এবং তিনি হয়ে ওঠেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং তাদের ভক্ত সমর্থকদের কাছে এক ধরণের চক্ষুশূল। তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি গায়ে ওল্ড ট্রাফোর্ডে তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ কিছু পারফর্মেন্স প্রদর্শন করেছেন বর্তমান মৌসুমেই। এই খেলোয়াড়কে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড চায়নি, যখন তারা তার জন্য ৮০ মিলিয়ন পাউন্ডের প্রস্তাবটি করেছিল।

যদিও এখনো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়নি, এবং তাকে এখনই ফ্লপ বলে আখ্যায়িত করাটা হয়তো এখনই উচিৎ নয়, তবুও তার সাম্প্রতিক খেলার মানের উপর ভিত্তি করে তাকে কি ফ্লপ বলাটাই অধিকতর মানানসই নয়? চলমান মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ইতিমধ্যে ৫৬টি গোল হজম করেছে, এবং মৌসুমের শেষ ভাগের জঘন্য পারফর্মেন্সগুলির পরে এমনও নজির তৈরি হয়েছে যে, ক্ষিপ্ত রেড ডেভিল সমর্থকরা তাকে উদ্দেশ্য করে বোমা হামলার হুমকিও দিয়েছে। তিনি কি পারবেন এসকল সমর্থকদের মন আবার নতুন করে জয় করে নিতে? আমরা মনে করি, এই প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে “না”।

উইনস্টন বোগার্দে – চেলসি (Winston Bogarde – Chelsea)

ইনি হচ্ছেন এমন একজন ডিফেন্ডার যাকে চেলসি ফ্রি ট্রান্সফারে দলে ভিরিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি প্রিমিয়ার লীগ এবং চেলসি’র ইতিহাসের সবচেয়ে দামী ফ্লপগুলির মধ্যে অন্যতম একজন। হ্যাঁ, আমরা উইন্সটন বোগার্দের কথাই বলছি। চলুন ব্যাপারটির আরো গভীরে যাওয়া যাক!

কেমন ছিল সফর? (How it was)

২০০০ সালে, অর্থাৎ নতুন শতাব্দীর শুরুতে, উইন্সটন বোগার্দেকে চেলসি ফ্রি ট্রান্সফারের মাধ্যমে, অর্থাৎ কোন প্রকার ক্লাব ফি ছাড়াই, এফসি বার্সেলোনা থেকে নিজেদের দলে নিয়ে আসে। কিন্তু, এখানেই মজার বিষয় হচ্ছে, কোন রকম ক্লাব ট্রান্সফার ফি না থাকলেও চেলসিকে তার স্বাক্ষর নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাকে দিতে হয় বিশাল বড় আকারের একটি চুক্তি, এবং অনেক বড় অঙ্কের বেতন। সেই চুক্তিটির অধীনে তিনি চেলসি’র কাছে থেকে পেতেন ৪০,০০০ পাউন্ডের সাপ্তাহিক বেতন, যা ২২ বছর আগে একটি দানবাকৃতির অঙ্ক ছিল, যদিও তখনও খেলাধুলার জগতে অর্থের অভাব ছিল না। 

চেলসি তাকে এত মূল্যবান একটি চুক্তি প্রদান করেছিল যেন তার উপর ভর করে ক্লাবটি নতুন শতাব্দীতে নতুন দিগন্ত ছুঁতে পারে এবং ধীরে ধীরে একটি শিরোপাপ্রত্যাশী দলে রূপ নিতে পারে। কিন্তু, তেমনটি তো হয়ইনি, বরং যা হয়েছিল তা হচ্ছে ঠিক তার বিপরীত!

পতনের শুরুটি কোথায় হয়েছিল? (Where did it go down?)

জিয়ানলুকা ভিয়াল্লি, যিনি উইনস্টন বোগার্দে’র ট্রান্সফারটি সম্পন্ন হওয়ার সময় চেলসি’র ম্যানেজার ছিলেন, তিনি ছিলেন খেলোয়াড়টির একজন বড় ভক্ত। কিন্তু, বোগার্দে দলে আসার কিছুদিনের মধ্যেই ভিয়াল্লিকে চাকরিচ্যুত করা হয়, এবং তার নিকট হতে দলের দায়িত্ব নেন আরেক ইতালিয়ান, ক্লাউদিও রানিয়েরি। 

নতুন কোচ এসে দলের পুরো চিত্রই পালটে দেন। তার কোন পরিকল্পনাতেই বোগার্দে’র জায়গা হচ্ছিল না, এমনকি বেশ কিছুদিন ধরে তাকে কোন খেলাতেই অংশ নিতে দেখা যায়নি। চেলসি তাকে বিক্রি করে দিতে চাইলেও উইন্সটন সেখানে একটি বড় চালাকি করার সুযোগ পেয়ে যান, এবং তিনি ক্লাবকে জানিয়ে দেন যে তার চার বছরের লম্বা চুক্তি শেষ হওয়ার আগে তিনি কোথাও যাবেন না। যা কথা তাই কাজ! তিনি চার চারটি বছর চেলসিতেই ছিলেন, মাত্র ১২টি খেলায় অংশ নিয়েছেন, কিন্তু প্রতি সপ্তাহে বিশাল অঙ্কের টাকা ঠিকই গুনেছেন। চার বছরে তার মোট কামাই ছিল প্রায় ১০ মিলিয়ন পাউন্ডের কাছাকাছি। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এটি তার জন্য খুবই লাভজনক হলেও প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাসে তিনি একজন ফ্লপ বলেই গণ্য হবেন।

পড়ুন:  প্রিমিয়ার লীগ ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা ১০টি মুহূর্ত

রাফায়েল ভারান – ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড (Raphael Varane – Manchester United)

অসম্ভব শোনালেও সত্যি, হ্যাঁ, এই তালিকায় রাফায়েল ভারানের নামও রয়েছে! এমন একটি নাম যা গত দশ বছরে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে শুধু সাফল্যই দেখে এসেছে। মাত্র এক বছরের পারফর্মেন্সের য়পর ভিত্তি করে কাউকে ফ্লপ উপাধি দেওয়া কতটুকু ঠিক তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, তবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের কারোরই এমন মনে হয়না যে রাফায়েল ভারান তার নামের উপর থেকে এই ফ্লপ-এর তকমাটি আর সরাতে পারবেন। চলুন জেনে নিই তার এই শোচনীয় সফর সম্পর্কেঃ

কেমন ছিল সফর? (How it was)

রাফায়েল ভারান স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দশ বছর খেলেছেন, এবং তার অসাধারণ ক্রীড়ানৈপূণ্যের মাধ্যমে সকল মাদ্রিদিস্তা সমর্থকদের মন জয় করে নিয়ে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে একজন লিজেন্ডে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি সেই মনমুগ্ধকর দলের একজন নিয়মিত ও সক্রিয় সদস্য ছিলেন, যেই দল টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লীগের শিরোপা জিতেছিল, এবং ২০১৪ সালে আবারো একবার সেই শিরোপাটি জিতেছিল। রিয়াল মাদ্রিদের একাডেমীতেই বড় হওয়ার পর সেখানকার প্রথম একাদশে তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে সুযোগ করে নেওয়া এবং এত শত তারকার মধ্যেও জ্বলে ওঠা অবশ্যই ভারানের জন্য বিশাল গর্বের বিষয়। কিন্তু, তার যেন এত সুখ আর সহ্য হচ্ছিল না, এবং তখনই তিনি ২০২১-২২ মৌসুমের শুরুতে যোগ দিলেন আরেক ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। আধুনিক বাংলায় বলতে গেলে, “বাঁকিটা ইতিহাস”!

পতনের শুরুটি কোথায় হয়েছিল? (Where did it go down?)

সাম্প্রতিক সময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বাজে ভাগ্য এবং অতি জঘন্য ম্যানেজমেন্টের শিকার হচ্ছেন বেশ বড়সড় সব তারকা ফুটবলাররা। জ্যাডোন স্যাঞ্চো ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোসহ গত বছর সেই তালিকায় নাম লিখিয়েছেন রাফায়েল ভারানও। মৌসুমের শুরুটা হয়েছিল তার জন্য বেশ ধীরগতির, যা প্রিমিয়ার লীগে আসা সকল নতুন খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। কয়েকটি ম্যাচে মোটামুটি পারফর্মেন্স দেখাতে পারলেও তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় ইঞ্জুরি সমস্যা। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক খেলায় অংশ নিতে যেয়ে তিনি প্রথম ইঞ্জুরির শিকার হোন, এবং তার পর থেকে তিনি মূল একাদশে একটানা দুইটির বেশি ম্যাচে অংশ নিতে সক্ষম হোননি। একটির পর একটি ইঞ্জুরি সামাল দিতে দিতেই তার পুরো মৌসুমটিই চলে গিয়েছে, এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড পড়ে গিয়েছে একটি শোচনীয় পরিস্থিতিতে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়িন এই ফরাসি ডিফেন্ডারকে দলে ভিড়ানোর জন্য ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ৪১ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করতে হয়েছিল, কিন্তু বিনিময়ে তিনি ক্লাবটিকে তেমন কিছুই দিতে পারেননি, যা দুই পক্ষের জন্যই খুবই দুঃখজনক।

জ্যাক রডওয়েল – সান্ডারল্যান্ড (Jack Rodwell – Sunderland)

ডিফেন্সিভ ফ্লপদের এই তালিকায় পরবর্তী নাম হচ্ছে জ্যাক রডওয়েলের, যাকে কি না ২০০৭ সালের দিকে এভারটনের যুবা দলে খেলাকালীন সময়ে ইংলিশ ফুটবলের পরবর্তী আশ্চর্য বালক হিসেবে গণ্য করা হত। সে অবস্থা থেকে এক সময় ম্যানচেস্টার সিটিতে খেলার সুযোগ পেলেও তা তিনি কাজে লাগাতে পারেননি, এবং পরবর্তীতে সান্ডারল্যান্ডে যোগ দিয়ে সেখানেও নিজের জায়গা বানিয়ে নিতে সক্ষম হোননি। 

কেমন ছিল সফর? (How it was)

জ্যাক রডওয়েল এভারটনের মূল একাদশের হয়ে তার প্রথম খেলতে নামেন ২০০৭ সালে, যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। ইংলিশ ফুটবলের কর্ণধারেরা তাকে দেশটির ফুটবলের ভবিষ্যৎ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছিল। তরুণ বয়সেই তিনি এভারটনের মূল একাদশে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নেন, এবং ডেভিড ময়েসের অধীনে চার চারটি সফল বছর পার করেন। এর পর থেকেই তিনি বিভিন্ন বড় বড় ক্লাবকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হোন, এবং ২০১২ সালে প্রথমবারের মত প্রিমিয়ার লীগের শিরোপা জেতার পরপরই ম্যানচেস্টার সিটি রডওয়েলকে দলে ভিড়ানোর জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে এভারটনের সামনে, এবং জ্যাক রডওয়েল সিটিতে যোগ দেন। এরপর থেকেই তার ক্যারিয়ারের গ্রাফটি নিম্নমুখী ঢালের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।

পতনের শুরুটি কোথায় হয়েছিল? (Where did it go down?)

জ্যাক রডওয়েলকে দলে ভিড়াতে ম্যান সিটিকে ১৫ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করতে হয়েছিল, কিন্তু সেখানে তিনি উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পারেননি, বরং একটানা ২ বছর ছিন্নভিন্ন সময় পার করেছেন। এই দুই বছরে তিনি ম্যান সিটির হয়ে মাত্র ২৫টি খেলায় অংশ নিতে সক্ষম হয়েছিলেন, বিশেষ করে ইঞ্জুরু সমস্যার দরুণ। উপায় না দেখে ম্যান সিটি তাকে সান্ডারল্যান্ডের নিকট বিক্রি করে দেয়। তার ক্যারিয়ারের চরম পতন এখান থেকেই শুরু হয়।

পড়ুন:  প্রিমিয়ার লীগে ফ্লপ খাওয়া সবচেয়ে দামী আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়েরা

২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়কালটি ছিল জ্যাক রডওয়েলের জন্য একদমই শোচনীয় এবং ধ্বংসাত্মক একটি সময়। ২০১৭ সালে সান্ডারল্যান্ড প্রিমিয়ার লীগ থেকে রেলিগেটেড হয়ে যায়, এবং তারও অনেক আগে থেকেই ক্লাবের সাথে রডওয়েলের সম্পর্ক অনেক খারাপ হয়ে যায়। ২০১৮ সালে দুই পক্ষের মীমাংসায় তার চুক্তিটি বাতিল করা হয়, এবং আজ পর্যন্ত তাকে সান্ডারল্যান্ড এর ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে ও ফ্লপ সাইনিং হিসেবে গণ্য করা হয়।

এলিয়াকিম মাংগালা – ম্যানচেস্টার সিটি (Eliaquim Mangala – Manchester City)

ম্যানচেস্টার শহরের দুই ক্লাবের ইতিহাস জুড়েই এমন ডিফেন্ডাররা রয়েছেন যাদের পেছনে তারা অসংখ্য পরিমাণে টাকা খরচ করেছেন। এবং ম্যানচেস্টার সিটিও ঠিক এমনটিই করেছিল যখন ২০১৪ সালে তারা পর্তুগিজ জায়ান্ট এফসি পোর্তো’র নিকট হতে ফরাসি ডিফেন্ডার এলিয়াকিম মাংগালাকে কিনেছিল। সে সময়কার অন্যতম উদীয়মান ডিফেন্ডার হিসেবে গণ্য হলেও ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি’র সিটি দলে তার পারফর্মেন্স দেখে থাকলে যে কেউই বলবে, “এলিয়াকিম মাংগালা একজন প্রিমিয়ার লীগ ফ্লপ”।

মাংগালাকে দলে নেওয়ার পর থেকে ম্যান সিটির সাথে যা যা হয়েছিল তা দুই পক্ষের জন্যই খুব একটা সুখকর ছিল না। চলুন এ ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাকঃ

কেমন ছিল সফর? (How it was)

২০১০ দশকের শুরুতে এলিয়াকিম মাংগালা ছিলেন এফসি পোর্তো এর ডিফেন্সের কর্ণধার। তাকে ঘিরেই দলটির ডিফেন্স সাজানো হয়েছিল, এবং তার উপর ভর করেই দলটি টানা লীগ শিরোপা জিতে যাচ্ছিল। টানা ২-৩ বছর ধরে তার ধারাবাহিক পারফর্মেন্সের উপর ভিত্তি করে ইউরোপের বেশ কিছু বড় বড় দলই তার স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। এবং, বিশাল বড় অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্যের উপর দাঁড়া করানো ম্যানচেস্টার সিটিরই অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছিল তাকে দলে ভিড়ানোর, এবং তারা তাই করেছিল। তখনকার সিটি কোচ ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনির অনেক পছন্দের খেলোয়াড় ছিলেন মাংগালা, এবং ৪২ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে তাকে দলে নিয়ে পেলেগ্রিনি অনেক খুশিও ছিলেন। কিন্তু, এটিই যে এলিয়াকিম মাংগালার প্রিমিয়ার লীগের দুঃখ গাঁথার এইতো মাত্র শুরু ছিল তা তারা কেউই তখন জানতো না!

পতনের শুরুটি কোথায় হয়েছিল? (Where did it go down?)

যেহেতু সেই সময়ে মাংগালাই ছিলেন প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে দামী ডিফেন্ডার, তাই ইংলিশ ফুটবলে এসে সবাইকে, বিশেষ করে নিজের দলের সমর্থকদের, খুশি করতে তাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। তার খুবই অধারাবাহিক ফর্ম এবং খেলার মাঠে তার অসন্তোষজনক পারফর্মেন্স এর কারণে তিনি ক্লাবটির আস্থা ভঙ্গ করেন এবং মূল একাদশ থেকে খুব জলদিই ছিটকে পড়েন। খুব তাড়াতাড়িই, ২০১৬ সালে, ম্যানচেস্টার সিটি তাকে ভ্যালেন্সিয়াতে লোনে পাঠায় নিজেদের বেতন কাঠামো ঠিক করার উদ্দেশ্যে, এবং সেবার তিনি লোন শেষে ফেরত আসার পর তাকে আরেকটি লোন স্পেলে এভারটনে পাঠানো হয়। 

এক কথায়, তিনি ম্যানচেস্টার সিটিতে নিজেকে একদমই খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি, নিজের জায়গাটি তৈরি করে নিতে পারেননি, এবং কোনপ্রকার ছাপই তিনি ক্লাবটিতে রেখে যেতে পারেননি। ম্যানচেস্টার সিটি তার পেছনে যে বিশাল অঙ্কটি ব্যয় করেছিল, তারাও সেটির বিনিময়ে তেমন কিছুই ফেরত পাননি, এবং সেজন্যই প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাসে এলিয়াকিম মাংগালাকে অতিরিক্ত দাম দিয়ে কেনা অন্যতম ফ্লপ একজন ডিফেন্ডার হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে।

শেষ বার্তা (Wrap up)

এটি ছিল আমাদের মতে প্রিমিয়ার লীগের সবচেয়ে দামী ৫ জন ফ্লপ খেলোয়াড়দের একটি এক্সক্লুসিভ তালিকা। তবে, শেষ হইয়াও হইল না শেষ! যেহেতু আমরা আপনাদের মতামতকে অবেক বেশি প্রাধান্য দেই, তাই অবশ্যই কমেন্ট সেকশনে জানিয়ে যাবেন আপনারা এই তালিকার সাথে একমত কি না। আমরা কি কোন নাম বলতে ভুলে গিয়েছি? আপনি কি কোন নাম উত্থাপন করতে চান? আপনার যেকোন মতামত আমাদেরকে জানান, এবং এমন অনেক নিবন্ধ পড়তে চাইলে আমাদের সাথেই থাকুন।

Share.
Leave A Reply