এবারের মৌসুমে লিভারপুলের বাজে ফর্ম যেন পিছু ছাড়ছেই না! তাদের সর্বশেষ ম্যাচে লিডস ইউনাইটেডের বিপক্ষে হারার মধ্য দিয়ে এনফিল্ডে তাদের টানা ২৯ ম্যাচের অপরাজিত থাকার রেকর্ডটি ভেস্তে গিয়েছে।
বিগত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর যাবৎ তারা ঘরের মাঠে নিজেদের সমর্থকদের সামনে কোন প্রিমিয়ার লীগ ম্যাচে পরাজয়ের স্বাদ পায়নি। এবার শুধু সেই মিষ্টিমধুর রেকর্ডটিই ভাঙেনি, বরং অল রেডস’রা পর পর দুই ম্যাচে রেলিগেশন জোনে অবস্থানকারী দু’টি দলের বিপক্ষে হেরেছে, যা নিজে থেকেও একটি রেকর্ডই বটে।
মৌসুমের শুরু থেকেই তারা যেটি করে আসছে, এই ম্যাচটির শুরুতেও তারা তাই করেছে — নিজেদের পায়ে তারা নিজেরাই সজোরে কুড়াল মেরেছে। ডিফেন্ডার জো গোমেজ এবং গোলকিপার এলিসন এর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি’র জের ধরে একটি ফাকা জালে বল ঢুকিয়ে লিডসকে লিড এনে দেন তাদের স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড রদ্রিগো মরেনো। তাদের খেলা সর্বশেষ ১২টি প্রিমিয়ার লীগ ম্যাচের মধ্যে এটি দিয়ে ৮ বার লিভারপুল প্রথমে গোল হজম করেছে। পুরো প্রিমিয়ার লীগে শুধুমাত্র সাউথ্যাম্পটনই এর চেয়ে বেশি বার প্রথমে গোল কন্সিড করেছে (৯ বার)।
নিজেদের মাঠে খেলা লিভারপুল মোহাম্মদ সালাহ্ এর করা অসাধারণ একটি ফিনিশের মধ্য দিয়ে ম্যাচে সমতা আনে ঠিকই, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে গোলের সুযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। তবে, গোলমুখে তারা বেশ কিছু দূরপাল্লার শট নিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু, লিডস গোলকিপার ইয়ান মেলিয়েও ছিলেন খাসা ফর্মে। ম্যাচজুড়ে মোট ৯টি সেইভ করে তিনি তার পূর্বের রেকর্ডটি ছুঁয়ে ফেলেন।
এরপর নিজের ২১তম জন্মদিনের আগের রাতে লিডস ইউনাইটেডের যুবা তারকা ক্রিসেন্সিও সামারভিল একটি লুজ বলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ম্যাচের ৯০তম মিনিটে এলিসনের বাম হাত উপেক্ষা করে লিভারপুলের জালে বল ঢুকান, যা গ্যালেরিতে উপস্থিত হাজারো হতাশাগ্রস্ত লিভারপুল সমর্থকদের হতাশা আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
গর্বের হোম রেকর্ড ভেঙে চুরমার (Shattered Home Comforts)
এই ম্যাচটির আগে ভার্জিল ভ্যান ডাইক লিভারপুলে যোগ দেওয়ার পর থেকে এনফিল্ডে মোট ৭০টি ম্যাচ খেলেছিলেন, যার মধ্যে ৫৯টিতে অল রেডস’রা জিতেছিল, এবং বাকি ১১টিতে করেছিল ড্র। তবে, এত বিশাল সেই অপরাজিত থাকার রেকর্ডটি যে এই লিডস ইউনাইটেড দলের বিপক্ষে ভাঙবে, যারা কি না এর আগের ৮টি প্রিমিয়ার লীগ ম্যাচে কোন জয় পায়নি, সেটি খুব কম মানুষই প্রেডিক্ট করেছিল। হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, ২০১৮ সালে মার্সিসাইডের ক্লাবটিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে ৩১ বছর বয়সী ভ্যান ডাইকের আগলে রাখা গর্বের এই রেকর্ডটি আসলেই ভেঙে গিয়েছে।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে লিভারপুল পর পর ৬টি হোম ম্যাচে পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু সে সময় ভ্যান ডাইক ইঞ্জুরি নিয়ে ছিলেন মাঠের বাইরে। তারপর দলে ঢোকার সাথে সাথে আবার তিনি লিভারপুলের ডিফেন্সকে কার্যকর করে তোলেন, এবং এনফিল্ডে অনুষ্ঠিত কোন ম্যাচেই হারের স্বাদ না নিয়ে এগুতে থাকেন। তবে, তিনি হয়তো স্বপ্নেও কখনো ভাবেননি যে লিডসের মত শোচনীয় পরিস্থিতিতে থাকা কোন ক্লাবের কাছে তার এই রেকর্ডটি ভাঙা পড়বে।
তবে, এটিও বলাই বাহুল্য যে, এমন নিথর একটি পারফর্মেন্স এর পরে ম্যাচের ৯০তম মিনিটে গোল খেয়ে ম্যাচ হারাটা অনেকটা ডিজার্ভই করেছিল লিভারপুল।
এছাড়া, আমরা যদি আরো কাছে থেকে নজর দেই, তাহলে দেখতে পাব যে, লিভারপুল এবারের মৌসুমে এ দিয়ে মোট চারটি ম্যাচ ইতিমধ্যে হেরেছে, যা কি না তাদের পুরো গত মৌসুমের মোট হারের সংখ্যার দ্বিগুণ। এছাড়া, ৪টি জয় ও ৪টি ড্র নিয়ে, এবারের মৌসুমের শুরুর ১২টি ম্যাচে তাদের রেকর্ড ২০১০-১১ মৌসুমে রয় হজসন এর অধীনে খেলাকালীন তাদের রেকর্ডটির সমতূল্য।
ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুল দলটি এখন প্রিমিয়ার লীগ টেবিলের ৯ম স্থানে অবস্থান করছে। বর্তমানে তারা লীগ লিডার্স আর্সেনালের থেকে ১৫ পয়েন্ট এবং চতুর্থ স্থানে থাকা নিউক্যাসেল ইউনাইটেড এর থেকে ৮ পয়েন্ট পিছিয়ে রয়েছে। এর চেয়েও দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে যে, তাদের খেলোয়াড়েরাও এখন বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্বকাপের আগে প্রচুর ম্যাচ থাকায় এবং তাদের দলের বেশ কিছু খেলোয়াড় ইঞ্জুরিতে থাকার কারণেই মূলত লিভারপুলের খেলোয়াড়দেরকে এমন ভাগ্যের শিকার হতে হচ্ছে। লিডস ইউনাইটেডের বিপক্ষে ম্যাচটিতে লিলি হোয়াইটস খেলোয়াড়েরা লিভারপুলের খেলোয়াড়দের থেকে ১১ কি.মি. বেশি দৌড়িয়েছে।
যেসব পজিশনে অধিকতর ফাটল ধরেছে (Creaking Parts)
লিভারপুলের হয়ে খেলার সময় এটিই জো গোমেজ এর করা প্রথম ভুল নয়। এর আগে নটিংহ্যাম ফরেস্ট এর বিপক্ষে ম্যাচটিতেও জো গোমেজ এর করা ভুলেই লিভারপুল গোল হজম করেছিল এবং পরাজিত হয়েছিল। তবে, দলটির জন্য তার চেয়েও বড় দুশ্চিন্তার কারণ হল, তাদের ডিফেন্সের কান্ডারী ভার্জিল ভ্যান ডাইক বর্তমানে একদমই ভালো ফর্মে নেই। লিডস এর বিপক্ষেও তাকে স্বভাবসুলভ চরিত্রে দেখা যায়নি। বরং, সামারভিল এর করা জয়সূচক গোলটির ক্ষেত্রেও তিনি ঠিকমত ক্লোজ ডাউন করতে পারেননি।
অল রেডস’দের ম্যানেজার ইয়ুর্গেন ক্লপ তার দলের পরাজয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তার দলের বাজে ডিফেন্ডিং এবং পুরো ম্যাচজুড়ে তার দলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের অপারগতাকেই।
ম্যাচ পরবর্তী প্রেস কনফারেন্সে ক্লপ বলেন, “লিডসের দ্বিতীয় গোলটির সময় আমরা যেভাবে ডিফেন্স করেছি, তা সত্যিই লজ্জাজনক, এবং এই পর্যায়ে এসে এমন ডিফেন্ডিং মোটেও কাম্য নয়।
“তবে, আমরা তাই করেছি, এবং এখন আমার নিকট এটির কোনই জবাব নেই যে তেমনটি আমরা কেন বা কিভাবে করেছি। ব্যাপারগুলি ঘটে গিয়েছে, এবং আমরা ম্যাচটি হেরেও গিয়েছি। এখন, আমাদের লক্ষ্য হল শুধু এই হারের কথা মাথা থেকে মুছে ফেলে পরবর্তী ম্যাচের জন্য প্রস্তুত থাকা।”
চ্যাম্পিয়নস লীগে অবশ্য লিভারপুল বেশ ভালো পজিশনে রয়েছে। গত মিডউইকে আয়াক্সকে ৩-০ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে তারা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রতিযোগিতাটির রাউন্ড অব ১৬ তে নিজেদের নাম লিখিয়ে ফেলেছে। তবে, যেই তারা তাদের ঘরোয়া লীগে ফিরেছে, সাথে সাথেই তাদের বাজে ফর্মটিও আবার যেন তাদের পিছু নিয়েছে।
অল রেডস’দের নানান দুর্গতি (Red Woes)
লিভারপুলের হয়ে গত কয়েক মৌসুম জুড়েই মিডফিল্ড নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন ব্রাজিলিয়ান তারকা ফ্যাবিনহো। তবে, এবারের মৌসুমে বরাবরই তাকে দেখে তার নিজের ছাঁয়াই মনে হয়েছে কেবল। ফলস্বরূপ, লিভারপুলও খুব বেশি ম্যাচে মিডফিল্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। কয়েক বছর ধরে টানা ক্রিকেট খেলায়, এবং তেমন কোন বিশ্রাম না নেওয়ায় এই মিডফিল্ড ডেস্ট্রয়ার বোধ হয় এবার কিছুটা ক্লান্তিতেই ভুগছেন। তবে, তার সেই ক্লান্তির পুরো প্রভাবটি এখন গিয়ে পড়ছে ইঞ্জুরি আক্রান্ত লিভারপুল মিডফিল্ডের উপর।
লিডস ইউনাইটেডের বিপক্ষে লজ্জাজনক হারের পর লিভারপুলের কিংবদন্তি সাবেক খেলোয়াড় গ্রাহাম সুনেস বলেছেন যে, মাঝ মাঠ নিয়ন্ত্রণ করার মত খেলোয়াড়ের অভাবই লিভারপুলকে এবারের মৌসুমে বার বার ভোগাচ্ছে।
“আপনি বলতে পারেন যে, লিডসের প্রথম গোলটি তারা সৌভাগ্যবশতই পেয়েছে। তবে, সেটির কারণে লিভারপুল ম্যাচটি হেরেছে বলে আমি মনে করি না। গত কয়েক বছর ধরে লিভারপুল যেমন খেলা আমাদের উপহার দিয়েছে, এই ম্যাচটিতে তার ধারে কাছেও তারা যেতে পারেনি। তারা সেই পরিমাণ উৎসাহ বা উদ্দীপনা নিয়ে এবারের মৌসুমে একটি ম্যাচও খেলতে পারেনি, এবং এই ম্যাচ তো একদমই না।
“আমার মনে হয় যে, লিভারপুল বিগত কয়েক বছর ধরে তাদের প্রতিপক্ষদের সাথে যেমনটি করে এসেছে, এই ম্যাচটিতে লিভারপুলের সাথেই তেমনটি করেছে লিডস ইউনাইটেড। লিভারপুল এক কথায় এতদিন নিজেরাই খেলার মাঝ মাঠ নিয়ন্ত্রণ করতো, তবে এই মৌসুমে তারা তা পারছে না। এখন তাদেরকেই সবাই মিডফিল্ডে ডমিনেট করে বেড়াচ্ছে। ফলে, তাদের রক্ষণভাগ পর্যাপ্ত পরিমাণে কভারও পাচ্ছে না। আবার, আক্রমণভাগেও অল রেডস’রা বেশ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে, এখন তারা নিজেদেরই ছাঁয়ায় পরিণত হয়েছে।”
যদিও মৌসুমের শুরু থেকেই বেশ কিছু বড় মাপের খেলোয়াড়দের ইঞ্জুরি লিভারপুলকে ও ইয়ুর্গেন ক্লপকে খুব পস্তাচ্ছে, তবুও তাদের দলের বিভিন্ন পজিশনেই পরিবর্তন আনাটা বেশ জরুরি হয়ে পড়েছে, কারণ দলের বহু খেলোয়াড়ই এখন ৩০ বছরের কোঠা পার করে ফেলেছেন। এছাড়া, গত ট্রান্সফার উইন্ডোতে একজন বিশ্বাসযোগ্য মিডফিল্ডার না কেনার সিদ্ধান্তটিও এখন লিভারপুল কর্তৃপক্ষকে ভোগাচ্ছে। কারণ, মাঠের অন্যান্য অংশে তারা যতই ভালো খেলুক না কেন, মিডফিল্ডের নিয়ন্ত্রণ না নিতে পারলে একূল ওকূল দুকূলই হারিয়ে বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
বিশ্বকাপ শুরুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত লিভারপুলের ফিক্সচার তালিকা ভরে টইটম্বুর হয়ে থাকায়, ক্লপকে খুব জলদিই এমন একটি উপায় বের করতে হবে যার মাধ্যমে লিভারপুলের মৌসুমটিকে আবারও সঠিক পথে ফেরানো সম্ভবপর হবে। ২০২১-২২ মৌসুমে অধরা কোয়াড্রাপল জেতার খুব কাছাকাছি এসেছিল যে লিভারপুল দলটি, তার থেকে বহুগুণে পিছিয়ে রয়েছে বর্তমানের এই অল রেডস বাহিণী। শুধু ভাগ্যের সহায় নয়, বরং এই মৌসুমে ভালো কিছু অর্জন করতে হলে তাদেরকে অবশ্যই নিজেদের খেলায় প্রচুর উন্নতিসাধন করতে হবে। নতুবা, এটিই হতে পারে এনফিল্ডে ইয়ুর্গেন ক্লপের সর্বশেষ মৌসুম।