কিছু অঘটন রয়েছে যেগুলি প্রকৃত অর্থেই অঘটন। হঠাৎ করে পেয়ে যাওয়া একটি সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবং ভাগ্যের জোড়ে প্রতিপক্ষের প্রচুর গোলের প্রচেষ্টা আটকিয়ে সেসব অঘটন ঘটায় অনেক ছোট দলেরা। কিন্তু, কিছু অঘটন রয়েছে, যেগুলি কাগজে কলমে কেউ প্রেডিক্ট করতে না পারলেও মাঠের খেলায় যোগ্যতার বলেই ঘটানো হয়, যেমন হল বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর ফিফা বিশ্বকাপে শিরোপা প্রত্যাশী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে হারের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসে সৌদি আরবের ছিনিয়ে নেওয়া আজকের জয়টি।
প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনা চার চার বার সৌদি’দের জালে বল জড়ায়, তবে তার মধ্যে তিন বারই গোলগুলি অফসাইডের কারণে বাতিল ঘোষিত হয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই সৌদি ডিফেন্ডার’দের দ্বারা সৃষ্ট হাই ডিফেন্সিভ লাইনের কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হবে। আর্জেন্টিনা অবশ্য বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়েই দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু করে, ঠিক একই ভঙিতে যেভাবে তারা প্রথমার্ধ ডমিনেট করেছিল।
কিন্তু, প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে যে তাদের প্রতিপক্ষ কতটা বেশি হিংস্র হয়ে উঠবে, তা নিশ্চয় আলবেসিলেস্তে’রা অনুমানও করতে পারেনি।
একমাত্র কোচ হিসেবে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে দুইবার আফ্রিকান কাপ অব নেশনস জেতা হার্ভি রেনার্ড এখন রয়েছেন সৌদি আরব জাতীয় ফুটবল দলের দায়িত্বে, এবং তারই নেতৃত্বে “গ্রিন ফ্যালকনস” খ্যাত সৌদি দলটি আর্জেন্টিনার মত হট ফেভারিট দলকেও হার মানিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। শুধু ডিফেন্সই নয়, আক্রমণভাগেও আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজকে চকমা খাইয়ে দুই দুইটি অবিস্মরণীয় মুহূর্তের জন্ম দেয় তারা।
সব মিলিয়ে, এটি ছিল একটি দূর্দান্ত ও পরিপূর্ণ একটি পারফর্মেন্স, যার পরতে পরতে ছিল অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও অঢেল বুদ্ধিদীপ্ততার এক অসাধারণ মিলন। ফলাফলটিও তাই বাস্তবতারই প্রতিফলনস্বরূপ।
গ্রুপ ‘সি’ এর এই প্রথম ম্যাচটি বিশ্বব্যাপী ফুটবল প্রেমীদেরকে উপহার দিয়েছে এবারের বিশ্বকাপের প্রথম অঘটন। শুধু এবারের বিশ্বকাপই নয়, বিশ্বকাপের সর্বকালের ইতিহাস ঘাটলেও এর চেয়ে বড় অঘটন আর খুব বেশি পাওয়া যাবে না। এই ম্যাচটির মধ্য দিয়ে খুব ভালো করেই বোঝা গেল যে, এবারের বিশ্বকাপ আসরে কোন দলকেই ছোট করে দেখা যাবে না, তা তাদের বিপক্ষে যত বড় দলই থাকুক না কেন।
আন্ডারডগ’দের মাঝে পুনরায় আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার (Renewed vigour among the underdogs)
সৌদি আরবের এই অবিশ্বাস্য জয়টির প্রভাব যে কত দলের উপর পড়বে, তা অভাবনীয়।
আর্জেন্টিনা তাদের খেলা সর্বশেষ ৩৬টি ম্যাচে অপরাজিত থেকে এবারের বিশ্বকাপে প্রবেশ করেছিল, যার মধ্যে সর্বশেষ জয়টি এসেছিল টুর্নামেন্ট শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগেই।
তাদের সর্বশেষ সেই জয়টি এসেছিল সৌদি আরবের প্রতিবেশী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে। যতটা সহজে ও নির্মমভাবে সেই ম্যাচটিতে জয় তুলে এনেছিল আলবেসিলেস্তে’রা, তাতে সৌদি আরবের আত্মা কিছুটা হলেও নিশ্চয় কেঁপেই উঠেছিল। তবে, তারা নিজেদের বিশ্বাস ধরে রেখেছিল, এবং হার্ভি রেনার্ড এর তৈরিকৃত নকশা খুব ভালো করেই অনুসরণ করতে পেরেছিল। তাতেই তারা আজ ইতিহাস গড়ে ফেলেছে। এমন বড় বড় প্রতিযোগিতায় হার্ভি রেনার্ড তার যোগ্যতা আবারও প্রমাণ করলেন।
ম্যাচটিতে সৌদি আরব প্রথমে আর্জেন্টিনার আক্রমণের ঢল সামলেছে, এবং তারপরে তারা সুযোগ বুঝে প্রত্যাঘাতও করতে সক্ষম হয়েছে। লিডে যাওয়ার পরও তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজেদের পরিকল্পনা ভোলেনি, বরং শেষ পর্যন্ত অসাধারণ ডিফেন্স জারি রাখতেও তারা সক্ষম হয়েছে। তাদের এই পরিপূর্ণ ও শাশ্বত পারফর্মেন্স শুধু গ্রুপ ‘সি’ থেকে তাদের পরের রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভাবনাই বাড়াবে না, বরং এবারের বিশ্বকাপে এশিয়ার অন্যান্য দল, যারা এত বড় মঞ্চে এসে তারকার চাপে হিমসিম খাচ্ছে, তাদেরকেও প্রচুর সাহস ও আত্মবিশ্বাস জোগাবে।
গ্রুপ ‘সি’ এর সমীকরণে বিশাল পরিবর্তন (Change in Group C power dynamics)
পাঁচ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল এবং বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের পাশাপাশি এবারের বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার জন্য আরেক অন্যতম ফেভারিট দল হল আর্জেন্টিনা। এর মানে এই যে, এবারের বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ের তিনটি ম্যাচে খুব সহজেই তিনটি জয় তুলে নিয়ে পরবর্তী রাউন্ডে তারা অগ্রসর হবে, এমনটিই প্রত্যাশিত ছিল।
তবে, সৌদি আরবের এই জয়টি পুরো সমীকরণকেই ঘুরিয়ে দিল। এখন গ্রুপের অন্য দুই সদস্য মেক্সিকো ও পোল্যান্ডও চাইবে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে অঘটন ঘটিয়েই পরের রাউন্ডে যেতে, এবং আর্জেন্টিনাকে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় করে দিতে।
সৌদি আরবের উপরই এখন নির্ভর করবে এই গ্রুপের ভাগ্য, কারণ তাদের বিরুদ্ধে ম্যাচ দুইটিতে মেক্সিকো ও পোল্যান্ডই ফেভারিট হিসেবে প্রবেশ করবে। কিন্তু, তাদের বিপক্ষেও জয় বা ড্র তুলে নিতে পারলে গ্রিন ফ্যালকন’রাই পরের রাউন্ডে যাবে। এছাড়া, আর্জেন্টিনাও চাইবে এই হার থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী দুই ম্যাচেই বড় ব্যবধানে জয় তুলে নিতে। তবে, আর যাই হোক, এটি মোটামুটি নিশ্চিত যে, এই গ্রুপে এখন প্রচন্ড পরিমাণে প্রতিযোগিতা দেখতে পাওয়া যাবে, যা বিশ্বকাপকে করে তুলবে আরো বেশি আকর্ষণীয়।
২০১০ বিশ্বকাপের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে কি? (2010 World Cup all over again?)
লা আলবেসিলেস্তে বা আর্জেন্টিনা সমর্থকদের জন্য, বা তাদের জন্য যারা একমাত্র লিওনেল মেসি’র কারণে এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার উপর বাজি ধরেছিলেন, এই পরাজয়টি যতই হতাশাজনক বা আকষ্মিক হোক না কেন, সুরঙ্গের শেষে এখনো একটি মৃদু আলোক ছটা অবশিষ্ট রয়েই গিয়েছে।
২০১০ সালে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপেও এমনি একটি ঘটনা ঘটেছিল!
সেবারের বিশ্বকাপ আসরের বিজয়ী দল স্পেন গ্রুপ পর্যায়ে তাদের প্রথম ম্যাচটিতে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজিত হয়েছিল। সুইস’দের হয়ে ম্যাচের ৫২ মিনিটের মাথায় একমাত্র ও জয়সূচক গোলটি করেছিলেন জেলসন ফার্নান্দেজ। তবে, স্পেনের টুর্নামেন্ট সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। তারা সেই ম্যাচটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, নিজেদের খেলার গতিতে পরিবর্তন আনে, বাকি দুইটি গ্রুপ ম্যাচেই জয়লাভ করে, এবং গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই পরের রাউন্ডে উত্তীর্ণ হয়। এরপর তারা আর কোন প্রকারের পিছুটান অনুভব না করেই বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছে যায়, এবং নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে অত্যন্ত কঠিন ও প্রতিযোগিতামূলক একটি ফাইনাল ম্যাচে তারা অতিরিক্ত সময়ে জয়সূচক গোল করে বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলে। সেটি ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ফাইনালগুলির একটি, এবং সেবার স্পেনের যাত্রাটিও ছিল অভাবনীয়।
এবারের বিশ্বকাপেও যদি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে, তবে ২০২০ সালের কোপা আমেরিকার পর এবারের বিশ্বকাপ শিরোপাটিও ঘরে তুলতেই চলেছেন মেসি এবং তার সতীর্থরা। সেটি অনেকের কাছেই একটি আকাশকুসুম কল্পনা মনে হলেও মোটেও অসম্ভব কিছুই নয়। এবারের বিশ্বকাপে তাদের পরবর্তী সকল প্রতিপক্ষকেরই তাই যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ।