ম্যানচেস্টার সিটি বর্তমানে নিজেদেরকে একটি অদ্ভূত পজিশনে খুঁজে পাচ্ছে। তাদের সাম্প্রতিক কিছু বাজে পারফর্মেন্স এর কারণে, যেমন কারাবাও কাপে সাউথ্যাম্পটনের বিপক্ষে ২-০ গোলের পরাজয় এবং ওল্ড ট্রাফোর্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ২-১ গোলের পরাজয়, তাদের সমর্থকগোষ্ঠি’র মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে।

বিশেষ করে সাউথ্যাম্পটনের বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল এবারের মৌসুমে ম্যান সিটি’র সবচেয়ে খারাপ পারফর্মেন্স। যদিও তারা ম্যাচটিতে একটি রোটেটেড দল নামিয়েছিল, তারপরও যে কেউ প্রত্যাশা করবে যে সেই দল নিয়েও তারা প্রিমিয়ার লীগের তলানির দলটিকে হারাতে পারবে। হারানো তো দূরের কথা, তারা ম্যাচটিতে ঠিকমত উঠে দাঁড়াতেও পারেনি।

ম্যাচটির শেষ নাগাদ ম্যানচেস্টার সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা কেভিন ডি ব্রুয়না, ইল্কাই গুন্দোগান, এবং আর্লিং হাল্যান্ডের মত বাঘা বাঘা খেলোয়াড়দেরকেও মাঠে নামান। কিন্তু, তারপরও তারা সাউথ্যাম্পটনের বিপক্ষে একটি শটও অন-টার্গেটে মারতে পারেননি।

সিটি’র ফর্মে এই সাম্প্রতিক পতনের মূল কারণ খোঁজার উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন প্রচুর সিটি সমর্থক এবং ফুটবল বোদ্ধারা। তাদের বিশ্বাস সিটি’র দলে আর্লিং হাল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তিই হল তাদের অধারাবাহিক ফর্মের একটি অন্যতম কারণ।

প্রথম দেখায় মনে হতে পারে যে, এমন একজন খেলোয়াড় যিনি ম্যানচেস্টার সিটি’র হয়ে ১৮টি ম্যাচ খেলেই প্রিমিয়ার লীগে ২৫টি গোল ইওরে ফেলেছেন, তিনি আবার দলটির পতনের কারণ কি করে হতে পারেন! কিন্তু, এটিও মনে রাখতে হবে যে, ঠিক আগের মৌসুমেই তাদের প্রতিবেশী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে মহাতারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো প্রচুর গোল করলেও তার দল কিন্তু মোটেও কোন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।

গত মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপত্তির ধারে কাছেও পৌছায়নি এখনো ম্যানচেস্টার সিটি। তবে, এবারের মৌসুমের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে এখন অনেকেই এ ব্যাপারটি ভেবে দেখছেন যে, আসলেই কি আর্লিং হাল্যান্ড ম্যানচেস্টার সিটি’র কোন প্রকার উন্নতিসাধন করতে পেরেছেন? এটি অতি সাধারণ একটি প্রশ্ন, কিন্তু এর উত্তর মোটেও সহজ-সরল নয়।

হাল্যান্ড কিভাবে এবারের মৌসুমে গোলস্কোরিং এবং সুযোগ তৈরিতে প্রভাব ফেলেছেন? (How has Haaland affected goalscoring and creation of chances?)

হাল্যান্ড এবারের মৌসুমে কি বিশাল সংখ্যায় গোল করে চলেছেন, এবং প্রিমিয়ার লীগের কত রেকর্ড তিনি ইতিমধ্যে ভেঙে ফেলেছেন, তা যেকোন প্রিমিয়ার লীগ দর্শকের জন্যই পুরনো সংবাদ।

তার গোলস্কোরিং রেকর্ডকে অভূতপূর্ব বললেও কমই বলা হবে, এবং স্বভাবতই, তিনি যে দলেই খেলুন না কেন, সেই দলটি তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠবে। দলের মূল উদ্দেশ্যই থাকবে তাকে ভালো সার্ভিস দেওয়া, এবং তার জন্য যত বেশি সম্ভব গোল করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। তাই, শুধুমাত্র এই কারণেই, দলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের গোলের সংখ্যা বেশ খানিকটা কমে আসবে, এটিও স্বাভাবিক।

পড়ুন:  মৌসুমের শুরুতে আমাদের করা প্রিমিয়ার লীগ সিজন প্রেডিকশনঃ এখন পর্যন্ত কতটুকু সত্যি হল?

আন্ডারস্ট্যাট ব্যবহার করে আমরা গত মৌসুমে ম্যান সিটি’র খেলা প্রথম ১৯টি প্রিমিয়ার লীগ ম্যাচের সাথে এবারের মৌসুমের প্রথম ১৯টি ম্যাচের তুলনা করে দেখেছি যে আসলেও তাদের মোট গোলসংখ্যা, এবং প্রত্যাশিত গোলসংখ্যার মধ্যে কোনপ্রকার পরিবর্তন এসেছে কি না। এ থেকে আমরা এটিও বুঝতে পেরেছি যে, প্রকৃতপক্ষে হাল্যান্ড দলটির উপর ভালো প্রভাব ফেলেছেন, নাকি খারাপ!

গত মৌসুমের তুলনায় ম্যানচেস্টার সিটি’র গোল রেকর্ড (Manchester City goal record compared to last season)

গত মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগে খেলা নিজেদের প্রথম ১৯টি ম্যাচে ম্যানচেস্টার সিটি স্কোর করেছিল মোট ৪৪টি গোল, যেখানে তাদের প্রত্যাশিত গোল সংখ্যা ছিল ৪৪.৮টি। সেখানে তাদের প্রত্যাশিত গোল সংখ্যা এবং প্রকৃত গোল সংখ্যার মধ্যে ১ এর চেয়েও কম পার্থক্য ছিল। এই মৌসুমে অবশ্য তারা ১৯টি ম্যাচ খেলে ইতিমধ্যে ৪৯টি গোল করে ফেলেছে, যেখানে তাদের প্রত্যাশিত গোল সংখ্যা ছিল ৪০.৯৯। অর্থাৎ, তারা প্রত্যাশার তুলনায় প্রায় ৮টি গোল বেশি করেছে।

প্রশ্ন যদি আসে শুধুমাত্র ম্যান সিটি’র গোল সংখ্যা নিয়ে, তাহলে তারা মৌসুমের একই পর্যায়ে গত মৌসুমের থেকে ৫টি গোল বেশি করেছে, যা প্রকৃত অর্থে খুব যে বেশি তাও কিন্তু না। এছাড়া, আপনি যদি প্রত্যাশিত গোলের দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন যে, গত মৌসুমে তাদের গোলস্কোরিং রেকর্ড ছিল বেশ মার্জিত ও ধারাবাহিক। তবে, এবারের মৌসুমের প্রত্যাশিত গোল সংখ্যা দেখলে আপনি বুঝবেন যে, তারা মৌসুমের প্রথমার্ধে ওভার-পারফর্ম করে ফেলায় দ্বিতীয়ার্ধে গিয়ে আন্ডার-পারফর্ম করার একটি সুযোগ রয়েছে।

ব্যক্তিগত দিক থেকে দেখলে, আর্লিং হাল্যান্ড এবারের মৌসুমে ১৮টি প্রিমিয়ার লীগ ম্যাচ খেলে ইতিমধ্যে ২৫টি গোল করে ফেলেছেন, যেখানে তার থেকে প্রত্যাশিত গোল সংখ্যা ছিল ১৭.৮টি। এ থেকে দেখা যায় যে, তিনি নিজেও তার প্রত্যাশিত গোল সংখ্যা থেকে ৭টি গোল বেশি করে ফেলেছেন। অর্থাৎ, শুধু তিনি নিজেই ওভার-পারফর্ম করছেন না, বরং সাথে সাথে তার দলকেও তিনি ওভার-পারফর্ম করাচ্ছেন। এর মানে হল এই যে, এখন যদি হঠাৎ করে তার গোল সংখ্যা কমে যায়, তাহলে সাথে সাথে তার দলের গোল সংখ্যাও কমে যাবে।

হাল্যান্ডের গোলস্কোরিং ফর্ম কি ম্যানচেস্টার সিটিকে কোনভাবে ক্ষতি করছে? (Is Haaland’s goalscoring form affecting Man City as a team?)

গত মৌসুমের এই পর্যায়ে ম্যানচেস্টার সিটি’র কোন খেলোয়াড়ের গোল ট্যালিই ডাবল ডিজিটে পৌঁছিয়েছিল না। তখন ৭টি গোল নিয়ে সিটিজেনদের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন বার্নার্দো সিলভা। তবে, তিনি ছাড়াও দলের আরো তিনজন খেলোয়াড় ৪টি করে, এবং আরো দুইজন খেলোয়াড় ৩টি করে গোল করেছিলেন। এটি কোন বিশাল অঙ্ক না হলেও এ থেকে বোঝা যায় যে, গত মৌসুমে তাদের পুরো দলেই গোল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।

পড়ুন:  ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ প্রিমিয়ার লিগের 6 ট্রান্সফার

এবারের মৌসুমে গোলস্কোরিং এর দিক দিয়ে তাদের স্কোয়াডের যে খেলোয়াড়টি হাল্যান্ডের পরেই অবস্থান করছেন, তিনি হলে ফিল ফোডেন, যার গোল সংখ্যা মাত্র ৭।

তবে, বিশ্বকাপের পর থেকে ফিটনেসজনিত কারণে ফিল ফোডেন ম্যান সিটি’র শুরুর একাদশে নিয়মিত জায়গা করে নিতে পারছেন না। উভয় পাশের উইঙে জ্যাক গ্রিলিশ এবং রিয়াদ মাহরেজকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন পেপ। তবে, এ পর্যন্ত এই দুই খেলোয়াড় লীগে সম্মিলিতভাবে কেবলমাত্র ৬টি গোলই করতে পেরেছেন।

কেভিন ডি ব্রুয়না ৩টি এবং হুলিয়ান আলভারেজ এবারের মৌসুমে মোট ৪টি গোল করতে পেরেছেন। তবে, তাছাড়া, ম্যান সিটি দলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের কেউই দুইটির বেশি গোল করতে পারেননি। এটিও মনে রাখতে হবে যে, হুলিয়ান আলভারেজ, যিনি কি না সম্মিলিতভাবে সিটি’র তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা, তিনি এবারের মৌসুমে সিটি’র ফরোয়ার্ড লাইনের সকল খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে কম সময় মাঠে খেলার সুযোগ পেয়েছেন।

হাল্যান্ডের উপর নির্ভরশীলতার কুফল ধীরে ধীরে টের পাচ্ছে সিটি (Dependence on Haaland starting to tell)

হাল্যান্ডের উপর নির্ভরশীলতা সম্পূর্ণরূপে খারাপ কোন বিষয় নয়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে দলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের কাছ থেকে যথেষ্ট সংখ্যক গোলের দেখা পাচ্ছে না ম্যান সিটি।

এসিস্টের বিষয়ে দেখতে গেলে, সিটি গত মৌসুমে ১৯টি ম্যাচের পরে মোট ২৬টি এসিস্ট অর্জন করতে পেরেছে, যদিও তাদের প্রত্যাশিত এসিস্টের সংখ্যা ছিল ৩০.২১। প্রায় ৪ গোলের এই আন্ডার-পারফর্মেন্স এর পেছনে দায়ী করা যেতে পারে গত মৌসুমে গোলের সামনে সিটি খেলোয়াড়দের বাজে ফিনিশিংকে।

এবারের মৌসুমে অবশ্য সেই এসিস্টের সংখ্যাটি বেড়ে দাড়িয়েছে ৪০ এ, যেখানে তাদের প্রত্যাশিত এসিস্টের সংখ্যা ছিল ৩১.৮৩। এই বিশাল ওভার-পারফর্মেন্স এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হল এই যে, দলের প্লেমেকাররা যেসকল ভালো গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন, তার বেশির ভাগই জালে ঢুকাতে সক্ষম হয়েছেন তাদের সতীর্থরা। তাদের এই অসাধারণ এসিস্ট রেকর্ডের পেছনে আরো একটি বড় কারণ হলেন আর্লিং হাল্যান্ড, যিনি কি না যেকোন অবস্থান বা পজিশন থেকে বিভিন্ন ভঙিতে গোল দিতে পারদর্শী, এবং তা তিনি ইতিমধ্যে প্রমাণও করেছেন।

পড়ুন:  সর্বশেষ প্রিমিয়ার লিগের সংবাদ রাউন্ড-আপ

গোলস্কোরিং এবং এসিস্ট তৈরির দিক দিয়ে ওভার-পারফর্ম করে ফেলায় এখন ম্যান সিটি এই ঝুঁকিতে আছে যে, মৌসুমের দ্বিতীয়ার্ধে হয়তো তাদের গোলের সংখ্যা ও এসিস্টের সংখ্যা উভয়েই ভাঁটা পড়তে পারে। যেহেতু তারা এমন একটি শিরোপার লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে, যেখানে তাদেরকে ধাওয়া করতে হচ্ছে, সেহেতু এমন পর্যায়ে গোল বা এসিস্ট খরা মোটেও তাদের জন্য সুখকর হবে না।

চূড়ান্ত উপসংহার (Final Conclusion)

আমরা এখন পর্যন্ত যা দেখেছি, তা থেকে আমরা এটি বলতেই পারি যে, হাল্যান্ড যোগ দেওয়ায় ম্যান সিটি দলে তেমন কোন উন্নতিসাধন হয়নি। যা হয়েছে, তা হল গত মৌসুমের তুলনায় শুধুই গোলস্কোরিং পরিসংখ্যানের উন্নতি।

নরওয়েজিয়ান এই স্ট্রাইকারকে কেনার আগে টানা দুই বছর ধরে সিটিজেনরা কোন প্রকার স্ট্রাইকার ছাড়াই খেলেছে, যেখানে তাদের মিডফিল্ডে খেলেছিলেন একজন করে অতিরিক্ত মিডফিল্ডার। এখন যখন তাদের নিকট ডি-বক্সে একজন বিশ্বমানের স্ট্রাইকার রয়েছে, তখন তারা মিডফিল্ডে একজন খেলোয়াড় কম পাচ্ছে, যার ফলে তাদেরকে তাদের খেলার ধরণও বদলাতে হচ্ছে।

যদিও এবারের মৌসুমে তারা অসংখ্য গোল করে ফেলেছে, তারপরও এটি বলাই বাহুল্য যে, ম্যান সিটি এখনও হাল্যান্ডের সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, এবং হাল্যান্ডও এখনও ম্যান সিটি দলের সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন।

গত মৌসুমের মত আধিপত্য বিস্তার করতে পারছে না ম্যান সিটি। তাদের গোলস্কোরিং রেকির্ড এবারের মৌসুমে অনেকটাই শ্রেয় হলেও, ডিফেন্সে তাদের পারফর্মেন্স এর ধারাবাহিকতা অনেকটাই কমে গিয়েছে। গত মৌসুমের এই পর্যায়ে ম্যানচেস্টার সিটি মাত্র ৯টি গোল হজম করেছিল, যেখানে তারা এবারের মৌসুমে ইতিমধ্যে ২০টি গোল হজম করেছে।

গত গ্রীষ্মকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোর শেষে এমনটিই মনে হয়েছিল যে, ম্যান সিটি এবং হাল্যান্ডের মিলন যেন স্বর্গে লেখা এক প্রেমের গল্পের মত, এবং সেটি এখনো সত্যি হওয়ার অনেক সম্ভাবনাই রয়েছে। সবকিছু যখন ঠিকঠাক যায়, তখন হাল্যান্ড ও ম্যান সিটি কি করতে পারে সেটিও আমরা জানি ও দেখেছি। কিন্তু, এখনো উভয় দিক থেকেই অনেক উন্নতির জায়গা রয়েছে।

এমনটি হওয়ার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে যে, এবারের মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগের সব ধরণের গোলস্কোরিং রেকর্ড ভেঙে ফেলার পরেও আর্লিং হাল্যান্ড প্রিমিয়ার লীগ শিরোপাটি হয়তো ছুঁতে পারবেন না।

Share.
Leave A Reply