...

বিভিন্ন সূত্রের মোতাবেক, বেনফিকা ফরোয়ার্ড ডারউইন নুনেজকে কেনার দৌড়ে ইংলিশ দল লিভারপুল এখন অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই চুক্তিটি চূড়ান্ত এবং স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।

অল রেডস’দের এবারের গ্রীষ্মকালীন ট্রান্সফার পরিকল্পনার অনেকটা জুড়েই থাকবে একজন ফরোয়ার্ডকে সাইন করানো। এবং তা থেকেই বোঝা যায় যে কেন তারা একজন যুবা ফরোয়ার্ডকে কেনার জন্য এত টাকা খরচ করতেও রাজি।

ইয়ুর্গেন ক্লপের অধীনে লিভারপুলের অসাধারণ সাফল্য গাঁথার পেছনে অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে তাদের ফরোয়ার্ড লাইনের তিন অ্যাটাকারের, যারা হলেন মোহাম্মদ সালাহ, সাদিও মানে এবং রোবার্তো ফিরমিনো। তাদের চমৎকার পারফর্মেন্সগুলি লিভারপুলের ভক্ত সমর্থকদের মনে অনেক দিন গেঁথে থাকবে। কিন্তু, অনেকটা কাব্যিক হলেও সত্য যে, লিভারপুলের সাথে উপরিউক্ত তিন খেলোয়াড়েরই চুক্তিতে আর মাত্র এক বছর করে বাকি রয়েছে। বাকি দুইজনকে নতুন চুক্তি অফার করলেও মনে হচ্ছে সাদিও মানে এবারের ট্রান্সফার উইন্ডোতে অন্য কোন দলে যোগ দিয়েই দিবেন।

Source: Twitter

নানান সূত্রের অনুসারে, সেনেগালিজ সুপারস্টার সাদিও মানে হচ্ছেন জার্মান জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখের টপ টার্গেট, অর্থাৎ বর্তমানে চলমান ট্রান্সফার উইন্ডোতে তাকে দলে ভেড়ানোই বায়ার্নের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। লিভারপুল সম্প্রতি মানের জন্য বায়ার্নের করা ৩০ মিলিয়ন ইউরোর একটি অফার প্রত্যাখ্যান করেছে, এবং তারা মানের উপর বসানো তাদের ৪০ মিলিয়ন ইউরোর প্রাইস ট্যাগ নিয়ে বেশ বদ্ধপরিকর।

এখন, যেহেতু মানের লিভারপুল ছাড়া অনেকটাই নিশ্চিত, এবং সালাহ্ ও ফিরমিনোর পরিস্থিতিটিও বেশ ঘোলাটে, তাই এটি খুব স্পষ্টই যে কেন তারা একজন ফরোয়ার্ডকে কেনার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

ডারউইন নুনেজ সম্পর্কিত বিভিন্ন পরিসংখ্যান

দল বদলের বাজারে বহুদিন পর পর একজন করে ভালো মানের স্ট্রাইকার উঠে আসেন, এবং এমন পরিস্থিতিতে একজন যুবা স্ট্রাইকার খুঁজে পাওয়া, যিনি সামনের বেশ কিছু বছর ধরে সার্ভিস দিতে পারবেন, তা তো আরো বেশি কঠিন। বর্তমান প্রিমিয়ার লীগ চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটি এবার তাদের দলে ভিড়িয়েছে বর্তমান যুগের সবচেয়ে নামকরা যুবা স্ট্রাইকারকে, যার নাম আর্লিং হাল্যান্ড। তাই, লিভারপুলও জানে যে ম্যান সিটিকে টক্কর দিতে হলে তাদেরকেও একটি নিজস্ব গোল স্কোরিং মেশিন দলে আনতেই হবে।

লিভারপুল কর্তৃপক্ষ ডারউইন নুনেজকেই সেই সমস্যাটির ‘সমাধান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, এবং বিশ্ব ফুটবলে নুনেজের এমন অসাধারণ অভ্যর্থনার পেছনে অবশ্যই বেশ কিছু বড়সড় কারণও রয়েছে। এই উরুগুয়ান ফরোয়ার্ড পর্তুগিজ লীগে একটি চমৎকার ২০২১-২২ মৌসুম পার করেছেন, যেখানে তিনি মাত্র ৪১টি ম্যাচ খেলে সর্বমোট ৩৪টি গোল করতে সক্ষম হয়েছেন।

Source: Twitter

যেহেতু এখনো তার বয়স মাত্র ২২ বছর, তাই এটিও বলাই যায় যে, তার ক্যারিয়ারের অনেকটা পথ এখনো চলা বাঁকি, এবং অনেক নতুন কিছু শেখার ও বোঝার, এবং তা নিজের খেলায় প্রয়োগ করার সুযোগও এখনো তিনি পাবেন। এটি তেমন কোন বিষ্ময়কর বিষয় নয় যে, এই যুবা তারকাকে দলে ভেড়াতে হলে লিভারপুলকে হয়তো অনেক অর্থ ব্যয় করতে হবে, এমনকি তার জন্য লিভারপুলকে নিজেদের ক্লাব রেকর্ড ট্রান্সফার ফিও পেরিয়ে যেতে হতে পারে। বিশেষ করে বর্তমান ফুটবল বাজার পর্যালোচনা করার পর, এমন ট্রান্সফার ফিও লিভারপুলকে খুব একটা ভাবাবে বলে মনে হয় না।

ফুটবল পত্রিকা দ্য অ্যাথলেটিকের খবর অনুসারে, লিভারপুল ইতিমধ্যে নুনেজের সাথে ব্যক্তিগত শর্তাবলিতে রাজি হয়েছে, এবং এখন শুধু বেনফিকার সাথে একটি ট্রান্সফার ফি চূড়ান্ত হওয়াই বাঁকি।

তবে আরেকটি বিশ্বস্ত সূত্র, দ্য রেকর্ড, দাবি করছে অন্য কিছু। এই পর্তুগিজ আউটলেট অনুসারে, লিভারপুল এবং বেনফিকা ডারউইন নুনেজের ট্রান্সফার ফি নিয়ে ইতিমধ্যে একটি সমঝোতায় পৌঁছে গিয়েছে।

তবে, সকল সূত্রের মতেই একটি ব্যাপার এখন পর্যন্ত ১০০% স্পষ্ট হয়েছে, এবং তা হল লিভারপুল নুনেজকে দলে নেওয়ার জন্য বেনফিকার কাছে ৬৮.৫ মিলিয়ন ইউরোর একটি অফার উত্থাপন করেছে, যে অফারটি বিভিন্ন অ্যাড-অন সহ ৮৫.৫ মিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত বাড়তে পারে।

সব ঠিকঠাক থাকলে নুনেজ লিভারপুলে একটি ৫ বছর মেয়াদী চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন, এবং যদি তার অ্যাড-অন এর সকল টাকা লিভারপুলকে আসলেই ব্যয় করতে হয়, তবে নুনেজ ভার্জিল ভ্যান ডাইককে টপকিয়ে লিভারপুলের ইতিহাসের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড় হিসেবে উন্মোচিত হবেন। ২০১৭ সালে ডাচ তারকা ভার্জিল ভ্যান ডাইক সাউথ্যাম্পটন থেকে লিভারপুলে যোগ দিয়েছিলেন ৭৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে।

ডারউইন নুনেজ লিভারপুলকে কি কি অফার করবেন?

লিভারপুল তাদের অসাধারণ স্কাউটিং সিস্টেম এর জন্য বহুকাল আগে থেকেই অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে। তারা সবসময় সেসকল খেলোয়াড়দেরই সাইন করে যারা তাদের খেলার ধরণ এবং দর্শন অনুযায়ী খেলতে সক্ষম। এমন সাইনিং সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলেন লুইস ডিয়াজ, যিনি এফসি পোর্তো থেকে লিভারপুলে যোগ দেওয়ার সাথে সাথেই সবার নজর কেড়েছেন, এবং জানুয়ারিতে অল রেডস’দের সেনায় যোগ দেওয়ার সাথে সাথেই তাদের বাম পার্শ্বের অ্যাটাক পুরোপুরি নিজেই সামলেছেন।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, নুনেজের খেলার স্টাইল ইয়ুর্গেন ক্লপের ফুটবল দর্শনের সাথে খুবই জুতসই। নুনেজও হাই-অক্টেন ফুটবল খেলেই অভ্যস্ত এবং লিভারপুলের রণকৌশলের সাথে তিনি জলদি মানিয়ে নিতে পারবেন বলেই আশা করা যায়।

এই ২২ বছর বয়সী ওয়ান্ডারকিডকে খুবই সহজ ভাষায় বর্ণণা করতে গেলে বলতে হয় যে, তিনি একজন নিখুঁত আধুনিক স্ট্রাইকার যার লক্ষ্য গোলের সামনে প্রায় অভেদ্য, এবং পাশাপাশি এরিয়াল উপস্থিতিও যার দানবাকার। লিভারপুলের আক্রমণভাগের অন্যান্য সকল খেলোয়াড়দের চেয়ে তিনি কিছুটা আলাদা মাত্রা যুক্ত করবেন, এবং তাদের আক্রমণের ধার আরও বৃদ্ধি করবেন বলেই আশা করছেন লিভারপুল সমর্থকরা। তবে শুধু তাই নয়, নুনেজ একজন বৈচিত্র্যময় ফরোয়ার্ডও বটে, কারণ প্রয়োজনে তিনি দু’পাশের মধ্যে যেকোন উইংগেই খেলতে পারদর্শী।

Source: Twitter

যেহেতু তার উচ্চতা ৬ ফুট ১ ইঞ্চি, তাই নুনেজ হতে পারবেন লিভারপুলের সেই আদর্শ টারগেট ম্যান যাকে তারা এতদিন খুঁজে পাচ্ছিল না। তার এরিয়াল ক্ষমতাকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায়ে কাজে লাগাতে পারেন ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ড এবং এন্ডি রবার্টসন, যারা দুই পাশের ফ্ল্যাংক থেকে ক্রসের বন্যা বওয়াতে পিছপা হবেন না। এছাড়াও তিনি লিভারপুলের যেকোন সেট পিস পরিস্থিতিতেও বিশালভাবে সাহায্য করতে পারবেন, তা হোক আক্রমণভাগে বা হোক রক্ষণভাগে। তার এসব গুণাবলির প্রমাণ তিনি বেনফিকাতে খেলাকালীন গত মৌসুমে নিয়মিতই দিয়েছেন।

লিভারপুলের পুরাতন এবং নতুন দুই তারকা ফরোয়ার্ড মোহাম্মদ সালাহ্ এবং লুইস ডিয়াজের জন্যও নুনেজের সাইনিংটি প্রচুর খুশির উদ্রেক ঘটাবে, এবং এই সাইনিং থেকে তারা অনেক লাভবানও হবেন। এই প্রতিভাবান উরুগুয়ান স্ট্রাইকার অবশ্য বেশ সুন্দর ড্রিব্লিংও করতে পারেন, এবং দলের অন্যান্যদের সাথে ওয়ান-টু-ওয়ান বা নিখুঁত লিংক-আপ প্লেতেও তিনি বেশ পারদর্শী। যদি এই যুবা স্ট্রাইকার নিজেকে ফিট রাখতে পারেন, তাহলে প্রকৃতপক্ষে তিনি অসংখ্য গোল করার পাশাপাশি অনেক অনেক এসিস্টও কুড়িয়ে নিতে পারবেন, যেমনটি করতে পারদর্শী ছিলেন রোবার্তো ফিরমিনো, যখন তিনি নিয়মিত প্রথম একাদশে খেলতেন।

নুনেজের খেলার একটি জায়গা যেখানে তিনি উন্নতি করতে চাইবেন, তা হল তার পাসিং। কিন্তু, সেটি এমনও কিছু নয় যা ইয়ুর্গেন ক্লপের সাথে কয়েকটি ইনটেন্স ট্রেনিং সেশনে সমাধান করা সম্ভব নয়।

সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ মৌসুমে, ডারউইন নুনেজ উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ এবং লিগা পর্তুগাল মিলিয়ে গড়ে প্রতি ৮১ মিনিটে একটি করে গোল করেছেন, যা বর্তমান ফুটবলের প্রেক্ষিতে সত্যিই দুঃসাধ্য এক কৃতিত্ব। এবং, তার সেই অসাধারণ নৈপূণ্যকে তিনি কয়েক গুণে বাড়িয়ে নিতে পারবেন যখন তিনি লিভারপুলের মত দলে এসে লিভারপুলের মিডফিল্ডার এবং প্লেমেকারদের সামনে খেলবেন। তার চমৎকার ফিনিশিং দক্ষতার উপর ভর করে তিনি গত সিজনে অর্জন করেছেন ৩টি হ্যাট্রিক এবং ৫ বার দুইটি করে গোল করার কৃতিত্বও।

যা বলা হয়েছে

ডারউইন নুনেজ গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালিস্টদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে একরকম অডিশনও দিয়ে ফেলেছেন, যখন তিনি বেনফিকার হয়ে লিভারপুলের বিপক্ষে খেলেছিলেন প্রতিযোগিতাটির নক আউট স্টেজে।

লিভারপুল ২০২১-২২ মৌসুমের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের কোয়ার্টার ফাইনালে বেনফিকার বিরুদ্ধে এগ্রিগেটে ৬-৪ গোলের একটি জয় হাসিল করে নেয়, এবং ডারউইন নুনেজ উভয় লেগেই ছিলেন প্রধান স্টার খেলোয়াড়, কারণ তিনি উভয় লেগেই গোল করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

দ্বিতীয় লেগে নুনেজ সমতাসূচক গোলটি করেছিলেন, যার ফলে সেই লেগটি বেনফিকা ৩-৩ গোলে ড্র করতে পেরেছিল, এবং ম্যাচশেষে লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ ছিলেন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

Source: Twitter

ম্যাচটির পরে এক সাক্ষাৎকারে লিভারপুল কোচ বলেছিলেন, “সে খুবই ভালো একটি ছেলে। আমি ওকে আগে থেকেই চিনতাম, অবশ্যই, কিন্তু সে আমাদের বিপক্ষে অনেক ভালো খেলেছে। সে শারিরিকভাবে খুবই শক্তিশালী, সে অনেক দ্রুতগামীও, আবার ফিনিশিংও তার খুবই ঠান্ডা মাথার। এটি খুবই ভালো। সে যদি ইঞ্জুরি এড়াতে পারে, তাহলে তার ক্যারিয়ার খুবই বর্ণাঢ্য হবে বলেই আশা করছি।”

ডারউইন নুনেজকে দলে ভেড়ানোর দৌড়ে অবশ্য লিভারপুল একা দল ছিল না। ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন বড় বড় দলই এই স্ট্রাইকারকে দলে নেওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল। তবে, তাদের বেশির ভাগই সেটি সফল করতে পারেনি তার নামের সাথে থাকা বিশাল প্রাইস ট্যাগটির কারণে। এমনও শোনা গিয়েছে যে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাকে আরো বেশি টাকা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি সবকিছু বিবেচনা করে লিভারপুলকেই বেছে নিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তের পেছনে অবশ্যই যে ব্যাপারটি অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে তা হল সরাসরি চ্যাম্পিয়নস লীগে খেলার সুযোগ।

সামনের কয়েকদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চলে আসবে বলেই মনে হচ্ছে, তবে এ ব্যাপারে এখন আর তেমন কোন দ্বিধা নেই যে, ডারউইন নুনেজ লিভারপুলেই যোগ দিতে যাচ্ছেন। তাকে দলে নিয়ে দলকে আরো মজবুত করে লিভারপুল চাইবে আগামী মৌসুমে আবারো সকল প্রতিযোগিতায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করতে।

 

Share.

Leave A Reply

Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.