ভূমিকা (Introduction)

যতই দিন যাচ্ছে, আমাদের প্রজন্মের সেরা সেরা সব ফুটবলারদের ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ততই ঘনিয়ে আসছে। এটি এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের একটি অযাচিত সত্য যে, আপনি চান বা না চান, সব ভালো জিনিসই একদিন সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছাবে। যেসব খেলোয়াড়েরা একসময় পুরো পৃথিবীকে নিজেদের পায়ের ঘুর্ণি দিয়ে নাচিয়েছে, তাদেরই এখন সময় এসেছে বুটজুতো খুলে শোকেসে সাজিয়ে রাখার। এই নিবন্ধে আমরা এমন ১০ জন খেলোয়াড়ের ব্যাপারে জানব যারা এবছর কাতারে অনুষ্ঠিতব্য ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২ এর পরেই আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিতে পারেন।

একটি স্বর্ণালি প্রজন্ম সমাপ্তির দিকে এগুচ্ছে (A Golden Generation Coming to Its End)

গত দুই দশক জুড়ে আমরা অসংখ্য চমৎকার খেলোয়াড়ে ভরা একটি স্বর্ণালি প্রজন্মের খেলা উপভোগ করেছি, যার মধ্যে দুইজন খেলোয়াড় এমনও ছিলেন যাদেরকে ধরা হয় ফুটবল ইতিহাসের সর্বোৎকৃষ্ট খেলোয়াড়দের মধ্যে দুইজন হিসেবে। সাম্প্রতিক কালে ফুটবল খেলার মান হঠাৎ করেই অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে। ফোডেন, হ্যালান্ড, আলেক্সান্ডার-আর্নোল্ডদের মত যুবা তারকারা স্পটলাইটে আসলেও তাদের পূর্বজ প্রজন্মের খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ারের শেষ ঘন্টা এখন শুধুমাত্র বেজে যাওয়ার অপেক্ষায়। এবছরের শেষে শীতকালে আসছে আরেকটি ফিফা বিশ্বকাপের আসর, যার শেষেই হয়তো এমন অনেক প্রাজন্মিক লিজেন্ডদের খেলা আমরা আর জাতীয় দলের হয়ে দেখতে পাব না। এমন কিছু বিখ্যাত নামই নিচে তুলে ধরা হলঃ

১. লিওনেল মেসি – আর্জেন্টিনা (1. Lionel Messi – Argentina)

আর্জেন্টিনীয় ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসির বয়স এখন ৩৪ বছর। এবছরের বিশ্বকাপটি হবে তার ৫ম বিশ্বকাপ, এবং অনেকেই মনে করছেন এটিই হবে তার শেষ বিশ্বকাপও। বর্তমানে পারিস সেন্ট জার্মেই নামক ফরাসি ক্লাবে খেলা এই কিংবদন্তি সম্প্রতি গত বছরই লম্বা অপেক্ষার পর জিতেছেন স্বনামধন্য কোপা আমেরিকা প্রতিযোগিতাটি। তার অসাধারণ ক্যারিয়ারের সুবাদে তাকে গোট (GOAT or Greatest Of All Time) বা সর্বকালের সেরা বলেও আখ্যায়িত করা হয়। তার ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে তিনি ৯৬৯টি ম্যাচে খেলে ৭৬২টি গোল করেছেন এবং তার নামে ৩২৮টি এসিস্টও রয়েছে। তিনি রেকর্ড ৭ বার ফিফা ব্যালন ডি’অর জিতেছেন, উয়েফা ইউরোপিয়ান প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার খেতাব জিতেছেন ৩ বার, এবং স্প্যানিশ লীগে ২ও বার গোল্ডেন বুট জিতেছেন, আর সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব জিতেছেন ১০টি মৌসুমে। ফুটবলের সকল শাখাতেই তার পরিসংখ্যান খুবই আকর্ষণীয়। ফুটবলের ইতিহাসে তিনি সর্বকালের ২য় সর্বোচ্চ গোলদাতা। ২০০৬ সালে তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম ফিফা বিশ্বকাপে খেলেন, যেখানে তিনি ৩ ম্যাচ খেলে ১টি গোল ও ১টি এসিস্ট নিজের নামে করে নিতে সক্ষম হোন। ২০১০ সালের বিশ্বকাপ তার জন্য খুব একটা সুখকর ছিল। সেবার তিনি ৫ ম্যাচ খেলে কোন গোল না করে শুধু একটি এসিস্ট নিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেন। তবে, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপটি ছিল এই আর্জেন্টিনীয় তারকার জন্য খুবই স্মরণীয়। সেবার তিনি ৭ ম্যাচে ৪টি গোল ও ১টি এসিস্ট করে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু, দূর্ভাগ্যবশত তারা ফাইনালে জার্মানির কাছে ০-১ গোলে হেরে যাওয়ায় মেসি’র আর বিশ্বকাপ জেতা হয়ে ওঠেনি। তবে, সেবার তিনি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের মাঠে খেলে বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জিতেছিলেন, যা কোনভাবেই ফেলে দেওয়ার মত ব্যাপার নয়। এরপর সর্বশেষ বিশ্বকাপে রাশিয়াতে মেসি ৪ নম্যাচ খেলে ২টি এসিস্ট ও ১টি গোল করতে সক্ষম হোন। সেবার আর্জেন্টিনা রাউন্ড অব ১৬ তে ফ্রান্সের বিপক্ষে ৪-৩ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। অর্থাৎ, সর্বমোট, লিওনেল মেসি এখন পর্যন্ত ফিফা বিশ্বকাপে ১৯টি ম্যাচ খেলে ১১টি গোল/এসিস্ট করতে পেরেছেন। 

লিওনেল মেসির পরিসংখ্যানই তার হয়ে কথা বলে। তার জাদুকরী ক্যারিয়ারকে তাছাড়া শব্দ দিয়ে বোঝানো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। ফিফা বিশ্বকাপই হল একমাত্র এমন শিরোপা যা মেসি এখন পর্যন্ত জিততে পারেননি, এবং এবছর তার নজর থাকবে এই শিরোপাটির উপরেই। কাতার লিও মেসি’র অপেক্ষায় থাকবে!

পড়ুন:  মিড-সিজন পর্যালোচনাঃ হাল্যান্ড কি ম্যানচেস্টার সিটি'র উন্নতিসাধন করতে পেরেছেন?

২. ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো – পর্তুগাল (2. Cristiano Ronaldo – Portugal)

পর্তুগিজ তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এবছর তার সর্বশেষ ফিফা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করবেন, কারণ তার বয়স বর্তমানে ৩৭ বছর ছুঁয়েছে। তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের সাথে কারো ক্যারিয়ারের তুলনা হয় না, এবং তিনি আজো ফুটবলের অধিকাংশ রাজপথে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছেন। তার ক্যারিয়ারজুড়ে তিনি এখন পর্যন্ত করেছেন ৮১৩টি গোল এবং ২৩১টি এসিস্ট। বিশ্বকাপ ফুটবলে তিনি ১৭টি ম্যাচ খেলে ২টি এসিস্টসহ ৭টি গোল করেছেন। তিনি ফিফা ব্যালন ডি’অর পুরষ্কারটি ৫ বার জিতেছেন, পর্তুগালের হয়ে উয়েফা নেশন’স লীগ এবং উয়েফা ইউরোও জিতেছেন একবার করে। ফিফা বিশ্বকাপে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেননি, কারণ এই প্রতিযোগিতাটিতে তার দল পর্তুগালের দলগত পারফর্মেন্স কখনোই আশানুরূপ হয়নি এবং কখনোই তারা ফাইনাল পর্যন্তও পৌঁছাতে পারেননি। একবার শুধু তিনি বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ২০১০ ও ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে রোনাল্ডোর নেতৃত্বে পর্তুগাল গ্রুপ স্টেজই পার করতে পারেনি, এবং ২০১৪ সালে তারা বিদায় নেন রাউন্ড অব ১৬ পর্যায় থেকে। কিন্তু, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো তার ভরপুর আত্মবিশ্বাসের জন্য বিখ্যাত, এবং একটি শেষ চেষ্টা তিনি অবশ্যই করবেন তার দলের জন্য এবং নিজের জন্য বিশ্বকাপের পরিসংখ্যান এর কিছুটা হলেও উন্নতি করার। এখন পর্যন্ত ক্রিশ্চিয়ানোর সফর খুবই স্মরণীয় হলেও বিশ্বকাপ শিরোপাটি যদি তিনি অর্জন করতে পারেন, তাহলে ব্যাপারটি হবে কেক এর উপরে চেরি স্থাপনের মতই।

৩. লুকা মদ্রিচ – ক্রোয়েশিয়া (3. Luka Modric – Croatia)

সদ্য সমাপ্ত ফুটবল মৌসুমে ক্রোয়েশিয়া ও রিয়াল মাদ্রিদের তারকা মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচের পারফর্মেন্স একদমই নজরকাড়া ছিল, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। মদ্রিচের বয়স এখন ৩৬ বছর এবং বলাই বাহুল্য এবারের কাতার বিশ্বকাপই হবে তার জন্য শেষ বিশ্বকাপ। জাতীয় দল ক্রোয়েশিয়ার হয়ে লুকা মদ্রিচ গত বিশ্বকাপে নিয়মিত মাঠ কাপিয়েছিলেন, এবং দলকে বিশ্বকাপের ফাইনালেও পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। ফাইনালের পথে তারা গ্রুপ স্টেজে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছিলেন, এবং এছাড়াও কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক রাশিয়াকে এবং সেমি ফাইনালে ইন-ফর্ম ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিলেন। ফাইনালে তারা মুখোমুখি হয়েছিলেন একটি অপ্রতিরোধ্য ফ্রান্স দলের। তবে, তারকায় ভরা সেই ফ্রান্স দলের বিপক্ষেও লুকা মদ্রিচ এবং তার দলের সদস্যরা একটি ভালো লড়াই উপহার দিয়েছিলেন। ম্যাচটিতে শেষ পর্যন্ত ক্রোয়েশিয়া ৪-২ গোলে হেরেছিল। বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার সুবাদে তিনি সেবছর ফিফা ব্যালন ডি’অর পুরষ্কারটিও জিতে নিয়েছিলেন। লুকা মদ্রিচ তার ক্লাব ক্যারিয়ারে মোটামুটি সকল শিরোপাই জিতেছেন, এবং যেকোন ভালো ফুটবলারের মত তারও ইচ্ছা থাকবে জাতীয় দলের হয়ে কিছু জিতেই অবসরে যাওয়ার। কাতার কি তবে মদ্রিচের জাদু দেখার অপেক্ষায় রয়েছে? সময়ই বলে দিবে এ প্রশ্নের উত্তর।

৪. নেইমার – ব্রাজিল (4. Neymar – Brazil)

নেইমারকে ধরা হয় এই প্রজন্মের সেরা এবং সবচেয়ে দক্ষ ড্রিবলারদের মধ্যে একজন হিসেবে। তার মত দারুণ ক্রীড়াশৈলি এবং অসাধারণ স্কিল মুভস খুব কম খেলোয়াড়ই প্রদর্শন করতে পেরেছেন আজ পর্যন্ত। ব্রাজিল এবং তার নিজের ভক্ত সমর্থকরা তাকে রোনালদিনহো গাউচো’র উত্তরসুরী হিসেবেই আখ্যায়িত করে থাকে। অনেকের মতে, ব্রাজিলের হয়েই নেইমার তার জীবনের সেরা খেলাগুলি খেলেছেন। দেশের জন্য ১১৭টি ম্যাচ খেলে তাই তার গোল সংখ্যা হল ৭১, যা ব্রাজিলের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা পেলে’র গোলের সংখ্যার থেকে মাত্র ৬টি কম। নেইমার ব্রাজিলের হয়ে ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ এবং একটি অলিম্পিক গোল্ড মেডেল জিতেছেন। তার বয়স এখন মাত্র ৩০ বছর, কিন্তু বিভিন্ন সূত্রের দ্বারা জানা গিয়েছে যে, তিনি ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপের পর জাতীয় দল থেকে অবসর নিবেন। নেইমার তার পুরো শক্তিমত্তা এবং গতি নিয়েই কাতারের দিকে ছুঁটবেন, কারণ ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতার সুযোগ হয়তো তিনি আর পাবেন না। নেইমার এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের কোটি কোটি সমর্থকদের কি এনে দিতে পারেন সেটি দেখার জন্যও বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে।

পড়ুন:  12 জন খেলোয়াড় যারা জুয়া খেলার সময় বড় অর্থ হারিয়েছে

৫. পেপে – পর্তুগাল (5. Pepe – Portugal)

পর্তুগালের জন্য গত প্রায় ২০ বছর ধরে এক কিংবদন্তি ডিফেন্ডারের নাম হল পেপে। ধরণীর বুকে তার মত হিংস্র এবং ডানপিটে স্বভাবের সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার আর একজনও আছেন বলে মনে হয়না। তিনি পর্তুগালের হয়ে ২০১৬ সালে উয়েফা ইউরো এবং ২০১৯ সালে উয়েফা নেশন’স লীগ জিতেছেন। পর্তুগালের জন্য তিনি এমনই একজন জরুরি খেলোয়াড় যে, বেশির ভাগ সময়ই কোচের জন্য তিনিই হোন মূল একাদশের প্রথম খেলোয়াড়। তিনি ফিট এবং এভেইলেবল থাকলে প্রতিবারই তিনি জাতীয় দলের খেলায় উপস্থিত থাকেন। তার বয়স এখন ৩৯ ছুঁয়েছে, এবং এবছরের বিশকাপের পরে আর কোন বিশ্বকাপে তিনি খেলবেন বলে মনে হয় না। ম্যান সিটি সেন্টার ব্যাক রুবেন ডিয়াসের সাথে জাতীয় দলে তার ডিফেন্সিভ জুটি খুবই দর্শনীয় হলেও বয়সের ভারে এবং নতুন খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়ার খাতিরে তিনিও এবারের কাতার বিশ্বকাপটি ঘরে তুলেই অবসর নিতে চাইবেন বলে ধারণা করা যায়।

৬. অলিভিয়ে জিরুদ – ফ্রান্স (6. Olivier Giroud – France)

৩৪ বছর বয়সী এই ফরাসি তারকা স্ট্রাইকার ২০১৮ সালে ফ্রান্সের হয়ে ইতিমধ্যে একটি বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছেন। জিরুদের জন্য এবছরের কাতার বিশ্বকাপই হবে তার ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ, কারণ প্রথমত, তার এখন বেশ বয়স হয়েছে, এবং দ্বিতীয়ত, ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশম্প জিরুদের পরিবর্তে এখন করিম বেঞ্জেমাকেই বেশি খেলাচ্ছেন। ফ্রান্সের হয়ে ১১২ ম্যাচ খেলে অলিভিয়ের জিরুদ করেছেন ৪৮টি গোল। গত বিশ্বকাপে অবশ্য তার পারফর্মেন্স খুব একটা নজরকাড়া ছিল না, এবং বর্তমান মৌসুমে করিম বেঞ্জেমা রয়েছেন উড়ন্ত ফর্মে। তাই জিরুদকে না খেলিয়ে বেঞ্জেমাকে খেলানোটাই কোচ দেশম্পের জন্য অধিক সমীচীন হবে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। 

এখন শুধু দেখার বিষয় যে ফ্রান্স জিরুদের ব্যাপারে কি করে কাতারে অনুষ্ঠিতব্য এবছরের ফিফা বিশ্বকাপে। 

৭. থিয়াগো সিলভা – ব্রাজিল (7. Thiago Silva – Brazil)

থিয়াগো সিলভা হলেন ফুটবল ইতিহাসের এবং সর্বকালের সেরা রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন। সাম্প্রতিক কালের ব্রাজিল দলের কান্ডারি এবং মেরুদন্ড বলা হয়ে থাকে তাকে। তিনি সেলেসাওদের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপে খেলেছেন (২০১০, ২০১৪, এবং ২০১৮)। এছাড়া, থিয়াগো সিলভা ব্রাজিলের হয়ে ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ এবং কোপা আমেরিকার শিরোপাও জিতেছেন। ব্রাজিল দল প্রতিভায় ভরপুর হলেও থিয়াগো সিলভার জায়গা নেওয়ার মত ডিফেন্ডারের উদয় এখনো দেশটিতে হয়নি। তাই, এবছরের বিশ্বকাপেও তাকে দেখা যাবে বলেই আশা করা যায়। তিনি ক্লাব ফুটবলেও চেলসির হয়ে বেশ ভালোই একটি মৌসুম পার করছেন। কিন্তু, ইঞ্জুরি সমস্যা তাকে বরাবরের মতই পীঁড়া দিয়ে যাচ্ছে। তার বয়সও হয়েছে ৩৭ বছর, এবং সে কারণেই এবছরের ফিফা বিশ্বকাপের পরে তাকে আর ব্রাজিলের জার্সি গায়ে দেখা যাবেনা, এমন ইশারাই তিনি সম্প্রতি দিয়েছেন। তিনি যদি ফিট থাকতে পারেন এবং ইঞ্জুরির কারণে যদি তার প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত না ঘটে, তাহলে ব্রাজিল দলের শক্তিমত্তা অনেকাংশেই বৃদ্ধি পাবে। কাতার থিয়াগো সিলভাকে একটি স্মরণীয় বিদায় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত!

৮. সার্জিও রামোস – স্পেন (8. Sergio Ramos – Spain)

অনেকের মতেই, সার্জিও রামোস হলেন সহজেই গত এক দশকের মধ্যকার সবচেয়ে সেরা রক্ষণভাগের খেলোয়াড়। তিনি বহু বছর ধরে তার সম্পূর্ণ গৌরব এবং শান দিয়ে স্পেনের রক্ষণভাগের পরিচর্যা করে আসছেন। তার বয়স এখন ৩৫ বছর, এবং এই বয়সে আসতে আসতে তিনি স্পেনের হয়ে প্রায় সব প্রতিযোগিতাই জিতে নিয়েছেন। তিনি দেশটির হয়ে ১টি ফিফা বিশ্বকাপ এবং ২টি উয়েফা ইউরো প্রতিযোগিতা জিতে নিয়েছেন। সব মিলিয়ে তার পরিসংখ্যান খুবই দারুণ হলেও বর্তমান মৌসুমটি ছিল তার জন্য খুবই আজব একটি মৌসুম। তিনি মৌসুমের শুরুতে পিএসজিতে নাম লেখানোর পর থেকে কিছুদিন পর পরই ইঞ্জুরিতে পড়েছেন এবং টানা কয়েকটি ম্যাচ খেলতে পারেবনি সিজন জুড়েই। এছাড়া, ২০২০ সালের উয়েফা ইউরোতে তাকে দলেই রেখেছিলেন না কোচ লুইস এনরিকে। যদি রামোসের উপর লুইস এনরিকের ভরসা ফিরে আসে, ইঞ্জুরি বিষয়ক কোন সমস্যার সৃষ্টি না হয়, এবং যদি শেষ পর্যন্ত এনরিকে তাকে বিশ্বকাপের শেষ দলে রাখেন, তাহলে এবারের বিশ্বকাপই হবে সার্জিও রামোসের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ।

পড়ুন:  এই মাসের জন্য 4টি সেরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ

৯. করিম বেঞ্জেমা – ফ্রান্স (9. Karim Benzema – France)

করিম বেঞ্জেমা বর্তমান মৌসুমে তার ধ্বংসাত্মক সেরা ফর্মে অবস্থান করছেন। তাকে বহুদিন ফ্রান্সের জাতীয় দল থেকে দূরে রাখা হয়েছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক নৈপূণ্যের প্রেক্ষিতে তাকে আবারো ফ্রান্স দলে জায়গা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে করিম বেঞ্জেমা তার জীবনের সেরা ফর্ম পার করছেন, এবং সেটির জন্যই ফ্রান্স এর মূল একাদশে প্রথম নামটিই হবে তার। গোলের সামনে তার লক্ষ্য পুরোপুরি নিশ্ছিদ্র এবং অব্যর্থ। তিনি এ বছরের ফিফা ব্যালন ডি’অর পুরষ্কারের জন্যও একজন অন্যতম প্রতিযোগি। সাম্প্রতিক সময়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগে তিনি নিজেকে একজন ক্ষুধার্ত গোলদাতায় পরিণত করেছেন। ফ্রান্স অবশ্যই কাতারে তার সবটুকু পরিষেবাই কামনা করবে। বর্তমানে তার বয়স ৩৪ বছর হওয়ায় এর পরের বিশ্বকাপে তার জন্য খেলাটা প্রায় অসম্ভবই হয়ে যাবে। এবারের বিশ্বকাপটিই তাই তার জন্য একটি বড় সুযোগ নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটিকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার, কারণ এর আগে তাকে ফ্রান্স দলে তেমন একটা সুযোগই দেওয়া হয়নি। ফ্রান্সের হয়ে তারপরও তিনি ৯৪টি ম্যাচ খেলে ৩৬টি গোল করেছেন। এছাড়াও তিনি ৩ বার সেরা ফরাসি ফুটবলারের খেতাব জিতেছেন, এবং সম্প্রতি উয়েফা নেশন’স লীগও জিতেছেন। করিম বেঞ্জেমা বর্তমানে যেকোন ডিফেন্ডারের জন্যই একটি বিপদের নাম। তবে কি তিনি অবসর নেওয়ার আগে শেষ বিশ্বকাপে নিজের সেরাটা দিয়ে দলকে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জেতাতে পারবেন? জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে আরো ৬ মাস!

১০. লুইস সুয়ারেজ – উরুগুয়ে (10. Luis Suárez – Uruguay)

লুইস সুয়ারেজ এবছর তার জীবনের ৪র্থ এবং সর্বশেষ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন। গত ১৫-২০ বছর ধরে তিনিই উরুগুয়ের প্রধান সৈন্য এবং প্রধান অস্ত্র। তাই, এবছর কাতারেও সম্পূর্ণ উরুগুয়ে তার দিকেই তাকিয়ে থাকবে দলকে সাফল্য এনে দেওয়ার জন্য। উরুগুয়ের হয়ে তার ক্যারিয়ার অতি বর্ণাঢ্য। দেশের হয়ে ১৩২ ম্যাচ খেলে লুইসিতোর করা গোল সংখ্যা হল ৬৮। এছাড়াও তিনি ২০১০/১১ সালে উরুগুয়েকে কোপা আমেরিকার শিরোপাও এনে দিয়েছেন। সেবছরসহ বহু বছর তিনি উরগুয়ের প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার পুরষ্কার জিতেছেন। ২০১০ সালের বিশ্বকাপের পর থেকেই লুইস সুয়ারেজ এবং এডিনসন কাভানি’র জুটি অনেক প্রশংসা কামিয়েছে। এল পিস্তলেরো খ্যাত সুয়ারেজের বয়স এখন ৩৫ বছর, এবং এই বিশ্বকাপটি খেলার পরেই তিনি উরুগুয়ে জাতীয় দল থেকে অবসর নিবেন বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। যদিও তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ইতিমধ্যে অনেক সাফল্যে সজ্জিত, কিন্তু অবসরের আগে তারও নিশ্চয় স্বপ্ন রয়েছে বিশ্বকাপ শিরোপাটি নিজের হাতে নেওয়ার। এখন শুধুমাত্র সময়ই বলে দিবে লুইস সুয়ারেজ কাতার বিশ্বকাপে বরাবরের মতই দর্শক মাতাতে পারবেন কি না। 

উপসংহার (Ending)

এবং এরই মাধ্যমে আমাদের তালিকার সমাপ্তি ঘটলো। তালিকার সকল খেলোয়াড়ই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে একেক জন কিংবদন্তি। কিন্তু সকলের মত তারাও পৌঁছে গিয়েছেন তাদের ক্যারিয়ারের ক্রান্তিলগ্নে। কেউ কেউ তাদের দেশের হয়ে অনেক কিছুই ইতিমধ্যে জিতে নিয়েছেন, কিন্তু আবারো জেতার ক্ষুধা তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আবার, আরেক অংশ রয়েছেন, যারা জাতীয় দলের হয়ে এখনও বিশ্বকাপ জিততে পারেননি, এবং তাই তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। তাদের সকলের জন্যই এবার একটি শেষ সুযোগ আসছে, কারণ এবারের বিশ্বকাপের শেষেই হয়তো তাদের সবাইকেই আন্তর্জাতিক ফুটবলকে এবং তাদের ভক্তদেরকে বলতে হবে “সায়োনারা”। 

এখন কেবল অপেক্ষার পালা! ফুটবল বিশ্বকাপের মহাযুদ্ধে কোন কোন কিংবদন্তি ফুটবলার আরেকটি বারের জন্য সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারে তা আমাদেরকে সময়ই বলে দিবে।

Share.
Leave A Reply