ছয় বছর ধরে এনফিল্ডের লাখো ভক্তদের মন মাতানোর পর এবারের ট্রান্সফার উইন্ডোতে সাদিও মানে লিভারপুল ছাড়তে পারেন!
লিভারপুলকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তেই হতো না যদি তারা মানের চুক্তিটিকে সেটির মেয়াদের শেষ ২ বছরে ঢোকার আগেই তাকে নতুন এবং আরো বেশি টাকার একটি চুক্তি অফার করতো। এখন যখন তারা এই পরিস্থিতিতে চলে এসেছে, তখন তারা প্রায় হারাতে বসেছে তাদের পুরো দলটির কেন্দ্রবিন্দুকে, তাও আবার এমন একটি সময়ে এসে যখন তাদের প্রিমিয়ার লীগে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ, পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি, কিনে ফেলেছে বর্তমান ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা যুবা স্ট্রাইকারকে, যার নাম আর্লিং ব্রাউত হাল্যান্ড।
লিভারপুল তাই অনেক প্রানপণ চেষ্টা করছে মানেকে নতুন একটি চুক্তি স্বাক্ষর করাতে, কিন্তু মানে তার চাহিদা একদমই কমাতে রাজি নন। যেহেতু মানে ৩০ বছরের কোটা প্রায় ছুঁয়েই ফেলেছেন, এবং তার ক্যারিয়ারে হয়তো আর একটি বড় চুক্তিই তিনি সাইন করতে পারবেন, তাই তার দিক থেকেও এই পদক্ষেপটি বেশ বোধগম্য।
এমনটি শনা যাচ্ছে যে, আফ্রিকান নেশনস কাপ জেতা এই সেনেগালিজ স্ট্রাইকারের কোন ইচ্ছাই নেই লিভারপুলের দেওয়া নতুন চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করার, যদিও তা পরিবর্তন হতে পারে আসন্ন প্রি-সিজন শুরু হওয়ার পরে। অন্যদিকে, অল রেডস’রা মানেকে তাদের দল থেকে বিদায় দেওয়ার কথা কেবল ভেবেও দেখবে শুধুমাত্র তখনই, যখন কোন ক্লাব তার জন্য ৪০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি অফার করতে রাজি থাকবে।
নানা সূত্রের অনুসারে, মানেকে দলে টানার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে জার্মান জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখ। এমনটি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি যে তাদের আক্রমণের মধ্যমণি রবার্ট লেওয়ান্ডোস্কি এবার অন্য দলে পাড়ি জমাবেন, এবং তাই তারা মানেকেই তাদের প্রধান লক্ষ্য বানিয়েছেন লেওয়ান্ডোস্কির বদলি হিসেবে, এবং এমন একজন খেলোয়াড় হিসেবে যিনি শুধু তাদের আক্রমণভাগের নেতৃত্বই দিবেন না, বরং তাদের হয়ে প্রচুর গোলও করতে পারবেন।
মানেকে দলে নিতে পারলে যেমন শক্তিশালী হয়ে উঠবে সেটি ভেবেই আরো মানেকে বিক্রি করতে পিছপা হবেন লিভারপুল কর্তৃপক্ষ। এই নিবন্ধটির বাকি অংশে আমরা এই ৩০ বছর বয়সী উংগারকে নিয়ে বায়ার্নের আশা ভরসার কথা জানন, এবং বিশ্লেষণ করব কেন লিভারপুলের উচিৎ তাদের সবটুকু দিয়ে হলেও মানেকে ধরে রাখা।
ইউরোপে বায়ার্ন মিউনিখের দাপট (Bayern Munich’s threat in Europe)
লিভারপুল বায়ার্ন মিউনিখকে একদম পাত্তাই দিয়েছিল না, যখন এই দুই দল ২০১৮-১৯ মৌসুমে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের রাউন্ড অব ১৬ এ একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিল।
বায়ার্ন সেই ম্যাচের প্রথম লেগে এনফিল্ডে লিভারপুলের সাথে গোলশূন্য ড্র করতে সক্ষম হলেও দ্বিতীয় লেগে ঘরের মাঠে তারা অল রেড’দের কাছে ৩-১ গোলে পরাস্ত হয়। আপনি কি অনুমান করতে পারেন যে সেদিন লিভারপুলের জয়ের নায়ক কে ছিলেন? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, সেটি ছিলেন সাদিও মানে। তার করা ২টি গোলের উপর ভর করেই লিভারপুল ৬ বারের ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন বায়ার্ন মিউনিখকে তাদের নিজেদের ভক্তদের সামনেই ধরাসয়ী করে।
লিভারপুল সেই মৌসুমে বহুদিন পর আবারো চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা জেতার গৌরব অর্জন করে। তাদের সেবারের চ্যাম্পিয়নস লীগ যাত্রাটি আরো স্মরণীয় হয়ে থাকবে সেবারের সেমি ফাইনালটির জন্য, যেখানে তারা বার্সেলোনার বিরুদ্ধে প্রথম লেগে ৪ গোলে পিছিয়ে পরেও এগ্রিগেটে জয় হাসিল করতে সমর্থ হয়েছিল। এরপর ফাইনাল ম্যাচে তারা অনেকটা একপেশে ভাবেই টটেনহ্যাম হটস্পার্সকে ২-০ গোলে হারিয়ে ১৪ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা ঘরে তোলে। এরপর থেকে লিভারপুল ২ বার চ্যাম্পিয়নস লীগের সেমি ফাইনাল খেলেছে, এবং একবার উঠেছে ফাইনালে। অর্থাৎ, যে ছয় বছর ধরে মানে লিভারপুলে আছেন, তার মধ্যে লিভারপুল ৩টি চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনাল খেলার কৃতিত্ব অর্জন করে ফেলেছে।
এছাড়াও, এই সময়ের মধ্যে মানে পরিণত হয়েছেন চ্যাম্পিয়নস লীগ (ইউসিএল যুগ) নক আউট ম্যাচে লিভারপুলের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতায়। অল রেডস’দের হয়ে তার খেলা ৫টি চ্যাম্পিয়নস লীগ টুর্নামেন্টে তার করা মোট গোলের সংখ্যা ১৪টি।
যেবছর মানে এবং লিভারপুল আলিয়াঞ্জ এরিনাতে বায়ার্নের বিরুদ্ধে মহাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তার ঠিক পরের বছরেই বায়ার্ন চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা ঘরে তুলেছিল। তবে যখন মানে তাদের বিরুদ্ধে তার জ্বালাময়ী পারফর্মেন্স দিয়ে জার্মান রাজধানীতে আগুন জ্বেলেছিলেন, ঠিক সে সময় থেকেই এই সেনেগালিজ জাদুকরকে দলে আনার চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে পড়ে বায়ার্ন মিউনিখ।
একটি ঐতিহ্যবাহী দল হিসেবে এটি বলাই বাহুল্য যে, বায়ার্ন মিউনিখের মত ঐতিহাসিক দল পুরো পৃথিবীতে খুব কমই আছে। কিন্তু, বর্তমানের আধুনিক ফুটবলের যুগে এসে এটিও খেয়াল রাখতে হবে যে, যেসব মৌসুমে বায়ার্ন চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা জিতেছে সেসব মৌসুম যদি আমরা বাদ দেই, তাহলে বাকি বেশির ভাগ মৌসুমে তারা প্রতিযোগিতাটির কোয়ার্টার ফাইনালের চড়াই পার করতে পারেননি।
তাই তারা সাবেক রেড বুল সালজবার্গের এই অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ডকে দলে নিতে অতি আগ্রহী, কারণ তিনি তাদেরকে শুধু চ্যাম্পিয়নস লীগে খেলার অভিজ্ঞতাই যোগাবেন না, বরং তাদের হয়ে এখনো কয়েক বছরের জন্য নিয়মিত গোলের গ্যারান্টিও দিবেন। যদি বায়ার্ন মানের সাথে এই চুক্তিটি চূড়ান্ত করে ফেলতে পারে, তবে তারা ম্যান সিটির মত শক্তিশালী দলগুলির সাথেও পাল্লা দিতে পারবে, যারা কি না কিনে নিয়েছে ভবিষ্যতের সুপারস্টার স্ট্রাইকার আর্লিং হাল্যান্ডকে। এই পয়েন্ট থেকেই আমরা সরাসরি আমাদের পরবর্তী আলোচনার বিষয়ে ঢুকে পড়ব।
ম্যান সিটি কিনে নিয়েছে হাল্যান্ডকে (City have signed Haaland)
লিভারপুলের সাম্প্রতিক সকল সাইনিংই প্রমাণ করে যে, অল রেডস’দের প্রশাসন খুব ভালো করেই জানে তারা কি চায়। তাদের সর্বশেষ সাইনিং গুলোর মধ্যে রয়েছেন ডিয়োগো জতা, ইয়াংস্টার ফাবিয়ো কার্ভালহো, এবং লুইস ডিয়াজ, যিনি কিনা ২০২০ সালের কোপা আমেরিকা প্রতিযোগিতায় লিওনেল মেসি’র সাথে সম্মিলিতভাবে গোল্ডেন বল জিতেছিলেন।
তবে, এসকল খেলোয়াড়ের কেউই কিন্তু স্বয়ং সাদিও মানে নন!
যদিও মানে গত মৌসুমের শেষের দিকে প্রায়ই লুইস ডিয়াজকে বামে পার্স্বের উইংগে জায়গা করে দেওয়ার জন্য সেন্ট্রাল অ্যাটাকে খেলেছেন, তবুও এটি মানতেই হবে যে এই কলোম্বিয়ান ফরোয়ার্ড কিন্তু এখনো প্রিমিয়ার লীগের সাথে মানিয়ে নিচ্ছেন, যেটিকে কি না ধরা হয়ে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন লীগ হিসেবে।
প্রিমিয়ার লীগে মানিয়ে নিতে কিছু সময় আর্লিং হাল্যান্ড এরও লাগবে বলেই আশা করা যায়, কিন্তু পাপ গার্দিওলার তৈরি করা সিস্টেমে কোন নতুন খেলোয়াড়েরই মানিয়ে নিতে ততটাও বেশি কষ্ট হয় না যেমনটি অন্যান্য দলে হয়ে থাকে, আর খেলোয়াড়টি যখন হয় হাল্যান্ড এর মত প্রতিভাসম্পন্ন, তখন সেই সময়কাল আরো কমে আসারই কথা। এই নরওয়েজিয়ান সুপার ট্যালেন্টের অসীম প্রতিভার উপর ভরসা রেখে তাই বলাই যায় যে, তিনি ম্যান সিটির হয়ে ভবিষ্যৎ মৌসুমগুলিতে প্রচুর গোল করবেন।
এখন যদি লিভারপুল সাদিও মানেকে হারায়, তাহলে এর মানে এই হতে পারে যে, তারা আবারও প্রিমিয়ার লীগ শিরোপাটি হাতছাড়া করতে যাচ্ছে। এর ফলে আবারও আরেক মৌসুমের জন্য তাদেরকে ৯০ পয়েন্ট অর্জন করেও প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা না জিতেই খুশি থাকতে হতে পারে। এছাড়াও, বলাই বাহুল্য, মানেকে ছাড়া তাদের আক্রমণের ধারও অনেকটাই কমে যাবে, কারন পরিসংখ্যান অনুসারে, মানে দলে থাকলেই তাদের আক্রমণ বেশি সক্রিয় থাকে।
এই বিষয়টিই এখন আমাদেরকে নিয়ে যাবে আমাদের আলোচনার পরবর্তী পর্যায়ে।
মানেই হচ্ছেন লিভারপুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় (Mane is Liverpool’s most important player)
যেদিন থেকে মোহাম্মদ সালাহ্ লিভারপুলের জার্সি গায়ে তুলেছেন, সেদিন থেকেই দলটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের পদবীটি তাকেই দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ মৌসুমেই তিনি হয়েছেন লিভারপুলের সর্বোচ্চ গোলদাতা, এবং এনফিল্ডে কাটানো তার প্রতিটি মৌসুমেই তিনি থেকেছেন প্রিমিয়ার লীগের শীর্ষ তিন থেকে পাঁচজন এসিস্টদাতাদের মধ্যে।
কিন্তু, অল-রাউন্ড খেলার উপর ভিত্তি করে তাকালে দেখা যাবে যে, মানে’র পরিসংখ্যান সালাহ্ এর চেয়ে অনেক বেশি ভালো। মানেই ডিফেন্সে বেশি সময় দেন, পজিশন রাখাতেও তিনি বেশি পারদর্শী, এবং তার পাসিংও অধিক একিউরেট। এছাড়াও, মানে ডিফেন্ডারদের নিজের দিকে টানেন অধিক প্রভাবের সাথে। তাই অনেক দিক থেকেই বলা যায় যে, সালাহ্ এর বাম পায়ের সুন্দর ছোঁয়া ও দ্রুতগতির দৌড় খুবই দর্শকপ্রিয় হলেও পুরো দলটির জন্য মানেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ক্লপ এর রণকৌশল অনুসারে লিভারপুলের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের উপর দায়িত্ব থাকে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের উপর প্রেসিং বজায় রাখার, এবং বর্তমানের লিভারপুল দলে এই দায়িত্ব পালনে মানে’র চেয়ে পটু আর কোন খেলোয়াড় নেই। একভাবে দেখলে, মানে এসকল দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেন বলেই সালাহ তার সুন্দর ফুটবল দিয়ে সারা পৃথিবীকে মাতাতে পারেন।
এই থিওরিটি প্রমাণিত হয়েছিল গত মৌসুমে, যখনই লুইস ডিয়াজকে বাম পার্শ্বের উংগে জায়গা করে দেওয়ার জন্য ইয়ুর্গেন ক্লপ সাদিও মানেকে সেন্ট্রাল অ্যাটাকারের পদে নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু, যেহেতু মানে স্বভাবসুলভভাবেই লেফট উইং থেকে আক্রমণ করে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ চিড়ে গোলমুখে ধেয়ে যেতে পারদর্শী, তাই সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে তিনি ততটাও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেননি, যার ছাপ পড়েছিল লিভারপুলের বেশ কিছু ম্যাচের পারফর্মেন্সে যেগুলিতে গোল করতে এবং জয় হাসিল করতে তাদেরকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
ক্লপ তার ট্যাকটিকাল সেটাপের এই অপরিহার্য অস্ত্রটিকে হারাবেন যদি লিভারপুল মানেকে ধরে রাখতে অক্ষম হয়। এর ফলে লিভারপুল অনেক বছর পিছিয়েও পড়তে পারে, যে সময়ে ম্যান সিটি প্রিমিয়ার লীগে তৈরি করে ফেলতে পারে একচ্ছত্র আধিপত্য। এবং, যে দলই মানেকে দলে নিতে সক্ষম হবে (যা বায়ার্ন মিউনিখ হওয়ার সম্ভাবনাই বর্তমানে বেশি), সে দলই ইউরোপীয় পর্যায়ে লিভারপুলের জায়গাটি দখল করে নিবে বলেই মনে হচ্ছে।
উপসংহার (Conclusion)
৩০ বছর বয়সে এসে মানে হয়তো আর বেশিদিন শীর্ষ পর্যায়ের ইউরোপীয় ফুটবল খেলতে সক্ষম হবেন না। কিন্তু, যতটুকু ফুটবলই তার মধ্যে বাকি আছে — যা প্রকৃতপক্ষে অনেক — তা যদি লিভারপুল তার মধ্যে থেকে বের না করে নিয়ে তাকে ছাড়াই একটি নতুন যুগে প্রবেশ করে, তবে তাদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে বলে মনে হয়।
লিভারপুল যদি মানেকে দিয়ে একটি নতুন চুক্তিতে স্বাক্ষর করাতে নাই পারে, তবে আমরা মনে করি তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো বিকল্প হল তাকে বিক্রি না করে তার বর্তমান চুক্তির শেষ পর্যন্ত, অর্থাৎ আগামী মৌসুমের সমাপ্তি পর্যন্ত, তাকে দলে রাখা। লিভারপুলের সর্বশেষ যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে ছাড়াই যদি তারা তাদের নতুন যুগে প্রবেশ করে, তবে হয়তো অল রেডস’দের অনেক বড় বিপদেই পড়তে হতে পারে!