গতকালের আগে পর্যন্ত এমন কোন সংবাদ বা রিপোর্ট সম্পর্কেই জানা যায়নি, যেখানে বলা হয়েছে যে লিডস ইউনাইটেডের ব্রাজিলিয়ান উইংগার রাফিনহার সম্ভাব্য গন্তব্যস্থল চেলসি হতে চলেছে। চেলসি এই ডিলটি হাইজাক করার ১২ ঘন্টা পূর্বেও মনে হচ্ছিল যে, গানারস খ্যাত আর্সেনালই রাফিনহাকে দলে নেওয়ার জন্য ফেভারিট। এখন যখন মনে হচ্ছে যে রাফিনহা চেলসিতেই যোগ দিতে চলেছেন, তখন সবার একটিই ভাবনা, এবং সেটি হচ্ছে যে, তাকে চেলসি’র সিস্টেমে কিভাবে ব্যবহার করা হবে। সেটি নিয়ে হাজারো জল্পনা কল্পনা চললেও, এ বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই যে, প্রিমিয়ার লীগের আগামী মৌসুমটি হতে চলেছে একটি ব্লকবাস্টার মৌসুম, কারণ সব দলই এবার ট্রান্সফার উইন্ডোতে ভালো ভালো সাইনিং করাতে সক্ষম হয়েছে।

লিডস ইউনাইটেডের এই প্রতিভাবান উইংগারকে দলে ভেড়ানোর জন্য গত মৌসুমের সমাপ্তির পর থেকেই ওঁত পেতে রেখেছিল ইউরোপের বড় বড় সব ক্লাবগুলি। এটি খুবই স্বাভাবিক বিষয় যে তার মত প্রতিভার অধিকারী একজন খেলোয়াড় বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়েই ক্লাব ছাড়বেন, বিশেষ করে বর্তমানের ফুটবল বাজারে। ব্যাপারটি এমন যে, লিডস ইউনাইটেড যদি গত মৌসুমে রেলিগেটেড হয়ে যেত, তাহলে রাফিনহা যেকোন মূল্যের বিনিময়েই ক্লাবটি ছাড়তেন। কিন্তু, যেহেতু তেমনটি ঘটেনি, সেহেতু তিনি এখন তার মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন ক্লাব কর্তৃপক্ষের উপর।

চেলসিকেই এখন এই ব্রাজিলিয়ান উইংগারকে দলে ভেড়ানোর দৌড়ে ফেভারিট মানতে হবে, কারণ তারাই সবচেয়ে বেশি মূল্য অফার করতে পারছে, যা প্রায় ৬৫ মিলিয়ন ইউরোর কাছাকাছি, এবং তার সাথে যুক্ত কিছু এড-অনস তো রয়েছেই। ব্লুস’রা রাফিনহার পরিস্থিতিটি খুব নীরবে ও নিভৃতে পর্যবেক্ষণ করছিলেন, এবং সুযোগ বুঝে খেলোয়াড়টিকে দলে নেওয়ার দৌড়ে বাকি সব ক্লাবকে পেছনে ফেলে এখন হট ফেভারিটস রূপে আবির্ভূত হয়েছেন।

যদি খেলোয়াড়ের নিজস্ব পছন্দের কথা বলা হয়, তাহলে তার পছন্দের গন্তব্য হবে বার্সেলোনা, যা তিনি অনেক আগে থেকেই স্পষ্ট করেছেন। কিন্তু, বর্তমানে এমনটিই মনে হচ্ছে যে, বার্সেলোনা অনেক আগেই লিডসকে জানিয়ে দিয়েছে যে এই ব্রাজিলিয়ানকে কেনার মত আর্থিক অবস্থা তাদের নেই। এছাড়া তারা লিডসকে আরো জানিয়েছে যে, রাফিনহাকে কেনার মত টাকা জোগাড় করতে হলে তাদেরকে প্রথমে কিছু খেলোয়াড় বিক্রি করতে হবে। 

৯০মিন নামক একটি সংবাদ আউটলেট কিছুদিন আগেই রিপোর্ট করেছিল যে, ব্রাজিলিয়ান এই উইংগারকে কেনার দৌড়ে সবচেয়ে এগয়ে ছিল নর্থ লন্ডনের ক্লাব আর্সেনাল। তবে তাদের করা সর্বশেষ বিডটিও লিডস এর ধার্য করা মূল্যের চেয়ে অনেক নিচে ছিল, এবং তাই লিডস তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। যেহেতু এখন এই খবরটি ছড়িয়েছে যে, চেলসি ডিলটি হাইজাক করতে চলেছে, এখন হয়তো আর্সেনালও চাইবে চেলসির চেয়ে বেশি মূল্য অফার করে রাফিনহাকে নিজেদের করে নিতে। তারা যদি তা করতে অক্ষম হয়, তাহলে হয়তো তাদের অন্যান্য অপশনের দিকেই তাকানো উচিৎ।

পড়ুন:  গত দশকের সবচেয়ে খারাপ প্রিমিয়ার লিগ একাদশ (2013 - 2022)

ব্লুস’রা অন্যদিকে গত মৌসুমে এক প্রকারের গোল খরায় ভুগেছিল, এবং তাই তাদের প্রধান লক্ষ্যই এখন হল তাদের আক্রমণভাগে বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা যোগ করে সেটিকে আরো শক্তিশালী করা। থমাস টুখেল হয়তো সে সবকিছুর উত্তর হিসেবে রাফিনহাকেই বেছে নিয়েছেন।

চেলসি কেন রাফিনহাকে দলে নিতে চাইছে? (Why are Chelsea going for Raphinha?)

এই সংবাদটি ছড়ানোর পর থেকেই চেলসিকে লক্ষ্য করে অনেকেই এই প্রশ্নটি ছুঁড়ছেন যে, ইতিমধ্যে রাইট উইংগারের পজিশনে এত টাকা খরচ করার পরও কেন আবার রাফিনহাকে তারা দলে ভেড়াতে চাচ্ছে? যদিও চেলসি প্রিমিয়ার লীগে একটি সম্মানজনক ৩য় স্থান নিয়ে গত মৌসুমটি শেষ করতে পেরেছিল, তবুও তাদের মৌসুমটি ছিল শিরোপাহীন, এবং সেটির পেছনে মূল কারণ হিসেবে দলটির সমর্থকরা চিহ্নিত করেছিল তাদের উইংগারদের ব্যর্থতাকে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে, চেলসির নিকট রাইট উইংগে খেলানোর মত বেশ কিছু ভালো ভালো অপশন রয়েছে, যারা যেকোন দলের জন্যই কাল হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম। ব্লুস’দের রাইট উইং ব্যাক বা রাইট ব্যাক পজিশনটিতে ধারাবাহিকভাবে দূর্দান্ত সব পারফর্মেন্স প্রদর্শন করেছেন রিস জেমস, যিনি কি না খুব কম সংখ্যক বারই কোন প্রকার ভুল করেছেন। কিন্তু, থমাস টুখেল এবং চেলসি সমর্থকদের জন্য সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয়টি হল তাদের আক্রমণভাগের কার্যকারিতা, যা গত মৌসুমে খুবই কম দেখতে পাওয়া গিয়েছে।

হাকিম জিয়েশ বা ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচ এর মত খেলোয়াড়দের মধ্যে অবশ্যই প্রতিভার কোনই ঘাটতি নেই। এমনকি, গত মৌসুমের নানা পর্যায়েও তারা তাদের জাদুকরি খেলা ও বুদ্ধিদীপ্ত পাসিং এর বেশ কিছু নিদর্শন রেখেছেন। কিন্তু, তাদের ইঞ্জুরির ইতিহাস চেলসি ফুটবল ক্লাবের জন্য একটি বিশাল বড় সমস্যার জায়গা। সাম্প্রতিক মৌসুমগুলির তদারকি করলে দেখা যাবে যে, এই দুই খেলোয়াড় খেলার মাঠের চেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন হাসপাতালের বিছানায়।

হাকিম জিয়েশ একজন গতিশীল এবং টেকনিকালি গিফটেড খেলোয়াড় হলেও তার শারীরিক সক্ষমতা বা শক্তিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, এবং তাকে প্রায়ই খেলার মাঠে ফিজিক্যালি ডমিনেটেড হতে দেখা গিয়েছে। তবে, তিনি মাঝে মধ্যেই গোলমুখে শক্তিশালী শট মেরে প্রতিপক্ষকে হকচকিত করে দিতেও বেশ পারদর্শী। মাঠে খেলাকালীন সময়ে তিনি ব্লুস’দের হয়ে বেশ কিছু স্মরণীয় মুহূর্তও তৈরি করেছেন, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তাকে মাঠে দেখাই যায় অনেক দিন পর পর, যার কারণ হল ইঞ্জুরি।

পুলিসিচ এর ব্যাপারেও ঠিক একই মন্তব্য করা যায়। যদিও তিনি শক্তিমত্তার দিক দিয়ে জিয়েশের থেকে কিছুটা এগিয়ে এবং একদম দিশেহারা পরিস্থিতি থেকেও কিছু একটা তৈরি করতে তিনি সক্ষম, তবুও তার ইঞ্জুরি ইতিহাস ক্লাবটির জন্য একটি বড় সমস্যার কারণ।

পড়ুন:  কিংবদন্তি প্রিমিয়ার লিগ ম্যানেজার

এবার যদি রাফিনহার ব্যাপারে বলা হয়, তাহলে বলতেই হয় যে তিনি জিয়েশ বা পুলিসিচ যা যা করেন, তার সবকিছুই করার সামর্থ্য রাখেন, এবং তার ইঞ্জুরি ইতিহাসও উপরে উল্লিখিত উভয় খেলোয়াড়ের চেয়েই উত্তম।

রাফিনহা বেশ মাপা ক্রস করতে পারদর্শী, এবং ১৮ গজের বক্সের বাইরে থেকে ঝড়ো গতির শট করতে তার কোনই জুড়ি নেই। টুখেল এই খেলোয়াড়টিকে অনেক বড় মাপের খেলোয়াড় হিসেবেই দেখেন, এবং তাকে দলে পেলে তিনি অবশ্যই অনেক বেশি খুশি হবেন।

ট্যাকটিকাল দিক দিয়ে রাফিনহা কিভাবে চেলসি দলে জায়গা করে নিতে পারবেন? (How does he technically fit into the club?)

থমাস টুখেলকে বর্তমানে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং সেরা কোচদের মধ্যে অন্যতম মানা হয়, এবং সেটির পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। সেগুলির মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে তার দলের জন্য এক এক ম্যাচে এক এক রকম গেমপ্ল্যান তৈরি করা। গত মৌসুমের কথাই ধরুন। তিনি বিভিন্ন দলের বিরুদ্ধে তার দলকে বিভিন্ন আঙ্গিকে সাজিয়েছিলেন। এমনও অনেক খেলা আমরা দেখেছি যেখানে তিনি তার দলটিকে সাজিয়েছিলেন এমনভাবে যেন প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দিতে পারেন। আবার অনেক ম্যাচে তিনি দল সাজিয়েছিলেন এমনভাবে যাতে প্রতিপক্ষকে ডমিনেট করতে পারেন এবং অনেকগুলো গোল করতে পারেন। তাই গত মৌসুমজুড়ে চেলসি’র প্লেয়িং স্টাইল প্রেডিক্ট করা ছিল প্রতিপক্ষের ম্যানেজারদের জন্য খুবই দূরুহ একটি ব্যাপার।

ধারণা করা হচ্ছে যে চেলসি তাদের পছন্দের “ফ্রন্ট ফোর” স্টাইলেই আগামী মৌসুমেও খেলতে থাকবে। টুখেল ভরসা রাখবেন আক্রমণভাগ জুড়ে তার ফরোয়ার্ডদের তুখোর ও গতিশীল মুভমেন্ট এর উপর। আমরা জানি যে, চেলসি তখনই সবচেয়ে দমদার খেলা খেলে থাকে যখন তাদের উইং ব্যাকদের আক্রমণে যোগ দেওয়ার লাইসেন্স প্রদান করা হয়ে থাকে এবং ইনভার্টেড পজিশন গ্রহণ করে পজিশন ফুটবল খেলার অধিকার দেওয়া হয়ে থাকে।

ব্রাজিলিয়ান তারকা রাফিনহা চেলসির সেই ইনভার্টেড অস্ত্র হিসেবে বেশ কার্যকর হবেন বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। তিনি প্রতিপক্ষের রাইট উইং দিয়ে ঢুকে একটি সেন্ট্রাল পজিশন গ্রহণ করতে পারবেন, যার ফলে রিস জেমস উইং দিয়ে ঢুকে পড়তে পারবেন, এবং বল পেলেই তার অনবদ্য ক্রসিং এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে সমস্যায় ফেলতে পারবেন। হাভার্টজ এবং ভার্নার উভয়েই প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের ফাঁক ফোকড় দিয়ে দৌড় দিত্ব বেশ পারদর্শী, এবং মেসন মাউন্ট তার পছন্দের সেন্ট্রাল পজিশন থেকে ইচ্ছামত ডিফেন্স চেড়া পাস দিয়ে যাবেন, এবং কিছুটা স্পেস তৈরি করতে পারলেই শট মারতেও পিছপা হবেন না। সব মিলিয়ে চেলসি’র আক্রমণভাগ রাফিনহাকে পেলে দুর্ধর্ষ একটি রূপ ধারণ করতে পারে।

পড়ুন:  Premier League Transfer Rumours Roundup_ Latest News on Manchester United, Arsenal, Liverpool Targets, and More

রাফিনহাকে দলে নিয়ে চেলসি কোন উপায়ে খেলতে নামবে? (How Chelsea will line up with Raphinha)

এতক্ষণের আলোচনায় আমরা এটি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি যে, রাফিনহা রাইট উইং দিয়েই তার সেরা খেলাটা খেলে থাকেন। তিনি যে পা ব্যবহার করে খেলে থাকেন, এবং যে ভঙিমায় তিনি আক্রমণ করতে ভালোবাসেন, সে সবকিছু বিবেচনা করলে তার জন্য রাইট উইংগারের পজশনটিই সেরা। এছাড়া তার দখলে রয়েছে ঝড়ো গতি, অসাধারণ ড্রিবলিং স্কিলস, এবং দূর্দান্ত স্কিল মুভস, যেগুলি ব্যবহার করে তিনি যেকোন ডিফেন্সকেই বিপদে ফেলতে পারেন।

চেলসি’র নিকট একজন ভরসাবান রাইট ব্যাক বা রাইট উইং ব্যাক রয়েছেন, যার নাম রিস জেমস। তার কারণেই রাফিনহাকে ডিফেন্স করা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত হতে হবে না বলেই ধারণা করা যায়। যদি তারা ইঞ্জুরি মুক্ত থাকতে পারেন, তাহলে এটি নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, চেলসির ডান দিকের উইং আগামী মৌসুমে এই দুইজন সুপারস্টারের দখলেই থাকবে।

রাফিনহা দলে যোগ দিলেও চেলসি’র জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গা বর্তমানে তাদের রক্ষণভাগ, চুক্তি সমাপ্তির ফলে যেখান থেকে তাদের বহু খেলোয়াড়ই অন্যান্য দলে ফ্রিতে যোগ দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছে যে, তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ম্যানচেস্টার সিটি থেকে তাদের সাবেক খেলোয়াড় নাথান আকে’কে ফিরিয়ে আনতে। যদি তিনি শেষ পর্যন্ত চেলসিতে যোগ দেন, তাহলে ধারণা করা যাচ্ছে যে এডিয়ার্ড মেন্ডির সামনে থিয়াগো সিলভা’র সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ পার্টনার হিসেবে তাকেই দেখা যাবে আগামী মৌসুমে। বাম পাশে থমাস টুখেল উইংগার হিসেবে যাকেই খেলান না কেন, লেফট ব্যাক বা লেফট উইং ব্যাক হিসেবে তিনি মারকোস আলনসো বা বেন চিলওয়েল এর মধ্যে যেকোন একজনকেই খেলাবেন, এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই।

চেলসি’র লেফট উইংগারের পজিশনটি আপাতত শূন্যই রয়েছে বলা যায়। তবে, এমনটিই শোনা যাচ্ছে যে, ম্যানচেস্টার সিটি’র আরো একজন খেলোয়াড় রহিম স্টার্লিংকে দলে ভিড়িয়ে তারা সেই শূন্যস্থানটি পূরণ করতে চান, এবং ডিলটি নাকি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হওয়ার বেশ কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছে। সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড পজিশনগুলিতে তাদের কোনরকম ঘাটতিই নেই, কারণ তাদের দলে রয়েছেন এনগোলো কান্টে ও জর্জিনহো’র পাশাপাশি ম্যাটেও কভাচিচ এবং সাউল নিগুয়েজও। এছাড়া ফরোয়ার্ড হিসেবে তাদের নিকট রয়েছেন জার্মান যুবা তারকা কাই হাভার্টজ, যিনি কি না দলটির হয়ে একটি দূর্দান্ত ২০২০-২১ মৌসুম পার করেছিলেন।

Share.
Leave A Reply