এ ব্যাপারে এক বিন্দুও সন্দেহ নেই যে, ডেভিড বেকহ্যাম হচ্ছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ইতিহাসের সবচেয়ে নামীদামী ও জনপ্রিয় খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন। ডান পাশের উইং থেকে তার অসাধারণ সব ক্রস দেওয়া বা ফ্রি কিক থেকে দারুণ বেন্ডিং শট নেওয়ার কীর্তিগুলো এখনো নিশ্চয় রেড ডেভিল সমর্থকদের স্মৃতিতে তাজাই হয়ে রয়েছে। আমাদের এই নিবন্ধটির উদ্দেশ্যই হল আপনাদেরকে ১৯৯৯ সালের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফিরিয়ে নেওয়া, এবং সে সময় ডেভিড বেকহ্যাম কি ধরনের ফর্মে ছিলেন তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা। এছাড়া, আমরা আরো দেখব যে, বর্তমানে এই ইংলিশ কিংবদন্তি কি করছেন, বা কোন অবস্থানে রয়েছেন। 

    ১৯৯৯ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ট্রেবল জয়ী মৌসুমটি বাদ দিলে তাদের ইতিহাসটি মূলত অপূর্ণই রয়ে যায়। এমন কীর্তি স্থাপন করতে পারা তারাই প্রথম ও সর্বশেষ ইংলিশ দল। সেই অসাধারণ ও দূর্দান্ত অর্জন এর কারণেই সেই ম্যান ইউনাইটেড দলটিকে ধরা হয় ক্লাবটির ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য দল হিসেবে। সেই দলের প্রত্যেকটি সদস্যকেও মানা হয় একেক জন কিংবদন্তি হিসেবেই। সেই অর্জনে যার অনেক বড় হাত ছিল, এবং যে খেলোয়াড়টি সেই দলের একজন অপরিহার্য অংশ ছিলেন, তিনি হচ্ছেন ডেভিড বেকহ্যাম।

    সাবেক এই ইংলিশ অধিনায়ক ছিলেন ৯০ এর দশকের যেকোন আধুনিক ফুটবলারের জন্যই একজন পথপ্রদর্শক। এর পেছনে মূল কারণই হল খেলার প্রতি তার নৈমিত্তিক বা ক্যাজুয়াল দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি কিছুদিন পর পরই নতুন নতুন হেয়ার কাট নিয়ে খেলতে নামতেন। তাছাড়া, তিনি অনেক ফ্যাশনেবল ও ট্রেন্ডি কাপড় চোপড়ও পরিধান করতেন, এবং তার খেলার একটি বড় অংশই ছিল তার ইউনিক স্টাইল ও চাকচিক্য।

    ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং তাদের খেলোয়াড়দের মনে ১৯৯৯ সালটি বহুদিন ধরে একটি বিশেষ জায়গা দখল করে রাখবে। সেই খেলোয়াড়দের মধ্যে যার জন্য মৌসুমটি সবচেয়ে বেশিই বিশেষ ছিল, তিনি হচ্ছেন ডেভিড বেকহ্যাম। ২০০৩ সালে অবশ্য তিনি রিয়াল মাদ্রিদের পথে পাড়ি জমান, এবং সেখানে বেশ কিছু সাফল্যমণ্ডিত মৌসুম কাটানোর পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে মুভ করেন, এবং সেখানকার মেজর লীগ সকারে লস এঞ্জেলেস গ্যালাক্সির হয়ে একটি গণজোয়াড় তৈরি করে ফেলেন।

    তবে, ডেভিড বেকহ্যাম নামটির সাথে শুধু ফুটবলই নয়, বরং আরো অনেক কিছু জড়িয়ে আছে। এই ইংলিশ কিংবদন্তি হচ্ছেন একাধারে একজন মডেল ও দেশপ্রেমিক, এবং সম্প্রতি তিনি একটি ক্লাবের মালিকানাও কিনেছেন। 

    চলুন এক নজর দেখে নেওয়া যাক এই ইংলিশ কিংবদন্তি ফুটবলারের জীবন বৃত্তান্ত। এখানে আমরা বিশেষ করে গুরুত্ব দিব তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের দিকে, এবং আরো জেনে নিব তার বর্তমান জীবনের নানা দিক ও অর্জন সম্পর্কে।

    পড়ুন:  কেন চেলসিকে ভিক্টর ওসিমেনের জন্য অল আউট করতে হবে

     

    তখনঃ ১৯৯৯ সালের ট্রেবল কাহিণী (Then: The 1999 Treble Story)

    ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তখন পুরোদমে ইংলিশ ঘরোয়া ফুটবল শাসন করছিল, এবং মহাদেশীয় পর্যায়েও নিজেদেরকে একটি শক্তিশালী দল হিসেবে গড়ে তুলেছিল। কিন্তু, তারপরও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের শিরোপাটি যেন কোনভাবেই তাদের নিকট ধরা দিচ্ছিল না।

    ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং ডেভিড বেকহ্যাম এর গল্প অসমাপ্তই থেকে যাবে, যদি না আমরা ক্লাবটির বিখ্যাত ‘৯২ এর ক্লাস এর কথা উল্লেখ না করি। সেসময়ের সেই ক্লাসটি রেড ডেভিলদের হয়ে এফএ ইয়ুথ কাপ থেকে শুরু করে বহু বয়সভিত্তিক শিরোপাই ওল্ড ট্রাফোর্ডে আনতে পেরেছিল, এবং ক্লাবটির কর্তৃপক্ষ সেই ব্যাচটির উপর অনেক প্রত্যাশাও তৈরি করেছিল, যা তারা ষোল আনা পরিশোধও করতে পেরেছিল।

    সেই ক্লাসটির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন পল স্কোলস, গ্যারি নেভিল, ফিল নেভিল, রায়ান গিগস, নিক বাট, মার্ক হিউস, স্টিভ ব্রুস, এবং ডেভিড বেকহ্যাম এর মত খেলোয়াড়েরা। যদিও এই ব্যাচটিতে আরো অনেক দেশী-বিদেশী খেলোয়াড়েরাই ছিলেন, তবুও শেষ পর্যন্ত দেখা গিয়েছে যে উপরে উল্লিখিত খেলোয়াড়েরাই ক্লাবটির সাফল্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পেরেছেন।

    ১৯৯৯ সালটিকে ডেভিড বেকহ্যাম এর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সাফল্যমণ্ডিত মৌসুম হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। তার ঠিক আগের বছরেই তাকে বিদ্রুপের নজরে দেখা হয়েছিল, যখন তিনি ফিফা বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন, এবং ম্যাচটিতে ইংল্যান্ডকে হেরে গিয়ে টুর্নামেন্টটি থেকে ছিটকে পড়তে হয়। সেবার ইংল্যান্ডের দল ছিল একের পর এক তারকায় ভরপুর, এবং টুর্নামেন্টের শুরুটিও তারা করেছিল ঝড়ের গতিতেই। এমনকি, এমনটিও মনে করা হয়েছিল যে, আর্জেন্টিনাকে হারাতে পারলে তারাই বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের জন্য ফেভারিট হয়ে উঠতো। ম্যাচটিতে তারা ভালো সূচনা করতে পারলেও, বেকহ্যামের লাল কার্ডের সুবাদে তাদেরকে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়, এবং তাই, হারের পুরো দায় এসে পড়ে বেকহ্যাম এর উপরেই।

    পরের মৌসুম, অর্থাৎ ১৯৯৮-১৯৯৯ মৌসুমের শুরুতে তাই তিনি যে যে অ্যাওয়ে স্টেডিয়ামেই যাচ্ছিলেন, সেখানেই তাকে বিদ্রুপের শিকার হতে হচ্ছিল। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত সেই বিশকাপে তার কীর্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা বিভিন্ন ব্যানার ও ফেস্টুন দেখতে পাওয়া যেন তখন একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। 

    পড়ুন:  ট্রান্সফার মার্কেটের অরাজকতার জন্য প্রিমিয়ার লীগের ক্লাবগুলিই দায়ী!

    তবে, এই সাহসী ইংলিশ উইংগার সেসকল চ্যালেঞ্জকে হার মানিয়ে, এবং নিজের অসাধারণ ইচ্ছাশক্তির অবিপ্রকাশ ঘটিয়ে সেই মৌসুমে একটি ব্যালন ডি’অর জেতার লায়েক পারফর্মেন্স উপহার দেন, এবং সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। সকল বিদ্রুপের জবাব দেওয়া সেই মৌসুমে তিনি ৯টি গোল ও ১৮টি এসিস্ট করতে সক্ষম হোন।

    সেবারের এফএ কাপের সেমি ফাইনালে তার করা আশ্চর্যজনক গোলটি সেই টুর্নামেন্টের সর্বকালের সবচেয়ে স্মরণীয় গোলগুলির মধ্যে একটি হয়েই থাকবে। সেসময়ের ২৩ বছর বয়সী বেকহ্যাম তার শক্তিমত্তার উচ্চসীমায় অবস্থাম করছিলেন, এবং তার ধারাবাহিকতাও ছিল দেখবার মতন। মূলত তার সেসকল গুণাবলির উপর ভর করেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ট্রেবল জয়ী ক্যাম্পেইনটি দিনের আলো দেখেছিল।

    যদিও আমরা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ১৯৯৯ সালের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা জয়ের নায়ক হিসেবে বেশির ভাগ সময়ই ওলে গানার সলসকিয়ের এর নাম শুনে এসেছি, তবুও এটি উল্লেখ না করলেই নয় যে, ফাইনাল ম্যাচে বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে করা তার দু’টি গোলের এসিস্টই কিন্তু করেছিলেন ডেভিড বেকহ্যাম। তার সেই দূর্দান্ত দু’টি ক্রসের কথা কোন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সমর্থকই সহজে ভুলতে পারবেন না।

    ম্যানচেস্টার শহরেই জন্ম নেওয়া এই স্টাইলিশ উইংগার এর জন্য ১৯৯৯ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাল, কেননা সেই বছরটিতেই তিনি নিজের সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছিলেন, নিন্দুকদের মুখ ফাটানো জবাব দিয়েছিলেন, এবং তার ক্লাবের সবচেয়ে সফল মৌসুমে একটি বিশাল অবদান রাখতেও সমর্থ্য হয়েছিলেন।

     

    এখনঃ ডেভিড বেকহ্যাম এবং ইন্টার মায়ামি (Now: David Beckham and Inter Miami)

    প্যারিস সেন্ট জার্মেই এর হয়ে একটি সফল মৌসুম পার করার পর নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারে ইতি আনেন ডেভিড বেকহ্যাম। তবে, নিজের জুতোজোড়া ট্রাঙ্কে তুলে রাখলেও অবসরের পর তিনি পুরোপুরিভাবে লাইমলাইটের বাইরে চলে যাননি। তার করার মত অনেক কিছুই ছিল, তবে তিনি ফুটবলেই নিজেকে নিয়োজিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন।

    তবে, তাকে বিভিন্ন আঙ্গিকেও আমরা দেখতে পেয়েছি। তার বিখ্যাত স্ত্রী ভিক্টোরিয়া বেকহ্যামই মূলত সেটির জন্য দায়ী। নিজে সুপারমডেল হওয়ার সুবাদে তিনি তার স্বামীকেও বিনোদন জগতে নিয়ে আসেন। ডেভিড বেকহ্যামকে তখন আমরা একজন মডেল, দেশপ্রেমিক, এবং হলিউডে একজন পার্ট-টাইম অভিনেতা হিসেবে দেখতে পেয়েছি।

    তবে, ২০১৮ সাল আসতে না আসতেই এই সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও রিয়াল মাদ্রিদ তারকা নিজেকে ফুটবল ব্যবস্থাপনার সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িত করে ফেলেন। 

    পড়ুন:  ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের শীর্ষ আন্ডারডগ দলগুলি নিয়ে আলোচনা

    এর গোড়াপত্তন আসলে হয়েছিল তারও অনেক আগে, অর্থাৎ ২০১২ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লীগ সোকারের সেসময়কার কমিশনার এই ঘোষণাটি দেন যে, বড় বড় স্টেকহোল্ডারদের সাথে তখন তাদের কথা চলছিল মায়ামি শহরে সর্বপ্রথম সোকার (ফুটবল) ফ্র‍্যাঞ্চাইজি প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে।

    তখন শহরটিতে আরেকটি বড় ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান ছিল, যার নাম হল মায়ামি ফিউশন। কিন্তু, তা বর্তমান শতাব্দীর শুরুতেই বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। শহরটিতে সে সময়ে বিদ্যমান একজন বড়সড় উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী, যার নাম ছিল মার্সেলো ক্লৌড়ে, ২০০৯ সালে একটি সূবর্ণ সুযোগ পেলেও সেই ফ্র‍্যাঞ্চাইজিটি কিনে নিতে ব্যর্থ হোন। 

    সেসময়ে, যখন ডেভিড বেকহ্যাম এলএ গ্যালাক্সিতে ক্রীড়ারত ছিলেন, তার নিকট ফ্র‍্যাঞ্চাইজিটিকে সুলভ মূল্যে কেনার একটি সুযোগ আসে। প্রস্তাবিত সেই নতুন ক্লাবটির নাম হতো ইন্টার মায়ামি, যা মেজর লীগ সোকারের একটি বিশাল শক্তিতে পরিণত হতো কয়েক বছরের মধ্যেই। কিন্তু, নানান কারণেই সে সময়ে ডেভিড বেকহ্যাম ক্লাবটি কেনা থেকে বিরত থাকেন। তবে, তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয় ২০১৮ সালে।

    ক্লাবটি এখন মাস ভাইদের যৌথ মালিকানার অধীনে রয়েছে (হোর্গে এবং হোসে মাস)।

    তবে, ক্লাবটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছে, এবং এখনো পর্যন্ত মেজর লীগ সোকারে নিজেদের সঠিক স্থান খুঁজে পেতে পারেনি। 

    ক্লাবটিতে বর্তমানে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বরত রয়েছেন বেকহ্যামেরই সাবেক টিমমেট, ফিল নেভিল। তিনি ইংল্যান্ডের জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের কোচের দায়িত্ব ছেড়ে তার বন্ধু বেকহ্যামের ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে কোচের দায়িত্বটি গ্রহণ করেন। তারপর থেকে তারা কিছু বড় বড় সাইনিং করাতে পেরেছেন, যার মধ্যে অন্যতম হলেন গঞ্জালো হিগুয়েইন, এবং ব্লেইজ মাতুইদি।

    ডেভিড বেকহ্যাম তার ফুটবলীয় ক্যারিয়ারে প্রচুর উত্থান পতন দেখেছেন। তিনি বহু সুদিন দেখেছেন, আবার ঠিক একইভাবে তার ক্যারিয়ারে কিছু কালো অধ্যায়ও ছিল। কিন্তু, সবকিছুর পরেও তিনি তার একনিষ্ঠতা এবং বৈচিত্র্যের উপর ভর করে নিজেকে আজও ফুটবল ও বিনোদন জগতে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছেন।

    ফুটবল প্রশাসক হিসেবে তার এই নতুন ক্যারিয়ারটি তার জীবনের একটি মজার অধ্যায় হিসেবে গড়ে উঠছে বলেই মনে হচ্ছে। এই অধ্যায়টির উপরও আমাদের সুনজর থাকবে, ঠিক তেমনিভাবে যেমনটি ছিল তার ফুটবলিং ক্যারিয়ারের উপর, এবং বিশেষ করে তার ১৯৯৯ সালের অধ্যায়টির উপর।

    Share.
    Leave A Reply