...

বহু ইতিবাচক কারণে এবারের ফুটবল বিশ্বকাপটি বিশ্বব্যাপী ফুটবল প্রেমীদের নিকট হতে যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছে, তেমনি অনেক নেতিবাচক কারণে তাদের নিকট প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে কাতারে অনুষ্ঠিতব্য এই ফুটবল উৎসবটি।

ইতিবাচক দিকগুলির মধ্যে অন্যতম হল প্রথম বারের মত এবারের ফিফা বিশ্বকাপটি অনুষ্ঠিত হতে চলেছে মধ্যপ্রাচ্যে, অর্থাৎ একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে (কাতার)। আই যাই হোক না কেন, এটি হল ফিফা বিশ্বকাপের আরেকটি আসর, যা দেখার জন্য মুখিয়ে আছে পুরো পৃথিবী। যার যার নিজের দেশ বা সমর্থন করা দেশের জন্য মেতে উঠতে প্রস্তুত সারা বিশ্ব। কেবল ৪ বছর পর পর তেমনটি করার সুযোগই যে তারা পান! উত্তেজিত না হয়েই বা উপায় কি তাদের? তবে, উত্তাল উন্মাদনার মধ্যে এমনও অনেক বিষয় রয়েছে যা এই বিশ্বকাপ আসরটিকে ঘিরে নেতিবাচকতার সৃষ্টি করেছে।

কাতার এবং তাদের বিভিন্ন ইসলামিক চর্চার উপর সারাবিশ্বের রাজনৈতিক কুনজর অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান, এবং প্রধানত সেই কারণেই এবারের বিশ্বকাপ আসরটি শুরুর পূর্বেই স্বাগতিক দেশটিকে নানারকম নেতিবাচকতার শিকার হতে হচ্ছে, যা মাঠের খেলার উপর থেকে সবার মনযোগও অনেকটাই সরিয়ে নিচ্ছে।

এ সবকিছুর মধ্যে আরেকটি বিষয় অনেক আগে থেকেই সকল ফুটবল অনুরাগীদেরকে চিন্তিত ও হতাশ করেছে, এবং সেটি হল যে, এবারের বিশ্বকাপটি অনুষ্ঠিত হতে চলেছে শীতকালে, সারাবিশ্বে সকল ক্লাব ফুটবলের মৌসুম যখন পুরোদমে চলছে, ঠিক তার মাঝেই। টুর্নামেন্টটির এমন সময়সূচির কারণে সারাবিশ্বের সকল ফুটবল ফেডারেশনগুলিকে তাদের নিজস্ব ফুটবলীয় ক্যালেন্ডারে অনেক পরিবর্তন আনতে হয়েছে, যার ফলে দেখা গিয়েছে যে, সকল ফুটবলারকেই প্রতি তিন দিনে একবার করে কোন প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে (ঘরোয়া লীগ, ঘরোয়া কাপ, বা মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট) খেলতে নামতে হয়েছে। 

গত বেশ কিছু আসর ধরে বরাবরই এমনটি দেখা গিয়েছে যে, প্রিমিয়ার লীগের খেলোয়াড়েরাই বিশ্বকাপের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকেন। কিন্তু, নানা কারণে এবারের আসরটি তাদের জন্য অনেকটা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমন সংকীর্ণ শেডিউলিং এর ফলে এবং লীগ হিসেবে খুবই ফিজিক্যাল হওয়ার কারণে ইউরোপের অন্যান্য লীগের চেয়ে প্রিমিয়ার লীগের খেলোয়াড়েরাই সবচেয়ে বেশি ইঞ্জুরিতে পড়েছেন। ইঞ্জুরি আক্রান্ত সেসব খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেকেই আবার তাদের নিজ নিজ দেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ একেক জন খেলোয়াড়

আমরা এখন এমন কিছু অসাধারণ খেলোয়াড়দের সম্পর্কে জানব, যারা কি না সেই সংকীর্ণ ক্যালেন্ডারের কারণেই মূলত অসময়ে ইঞ্জুরিতে পড়েছেন, এবং খুব সম্ভবত এবারের বিশ্বকাপ থেকেও ছিটকে পড়েছেন।

আর্থার মেলো – লিভারপুল, ব্রাজিল (Arthur Melo – Liverpool, Brazil)

ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার আর্থার গত গ্রীষ্মকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোতে বেশি গেমটাইম এর আশায় জুভেন্টাস থেকে ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলে পাড়ি জমান। ইয়ুর্গেন ক্লপের দলে যোগ দেওয়ার পেছনে তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল প্রিমিয়ার লীগে ভালো খেলে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দলে ঢুকে পড়া। তবে, তিনি যেমনটি আশা করেছিলেন, তার ভাগ্য তার ঠিক উল্টোটাই তাকে উপহার দিয়েছে।

গত অক্টোবরে এই ২৬ বছর বয়সী মিডফিল্ডার অনুশীলন করার সময় তার উরুতে চোট পান এবং প্রায় তিন মাসের জন্য সাইডলাইনে চলে যান। ইঞ্জুরিতে পড়ার আগে তিনি ইয়ুর্গেন ক্লপের দলটির হয়ে মাত্র ১৩ মিনিটের ফুটবল খেলতে পেরেছিলেন।

ব্রাজিলের হয়ে আর্থার মেলো এ পর্যন্ত সর্বমোট ২২টি ম্যাচ খেলেছেন। ২০১৯ সালে ব্রাজিলের কোপা আমেরিকা জয়ী দলের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি।

রিস জেমস – চেলসি, ইংল্যান্ড (Reece James – Chelsea, England)

এমনটিই মনে হচ্ছিল যে, ক্লাব (চেলসি) এবং জাতীয় দল (ইংল্যান্ড) এর হয়ে রাইট উইং ব্যাক পজিশনটি একদম নিজের নামেই করে নিয়েছেন রিস জেমস। ডিফেন্স হোক বা অ্যাটাক — মাঠের যেকোন স্থানেই তার ক্রীড়ানৈপূণ্য ছিল দেখার মত। এবং এই ফর্মটি তিনি অনেকদিন অবধি ধরেও রেখেছিলেন। তবে, গত মাসের মাঝ বরাবর উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগে এসি মিলানের বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে তিনি তার হাঁটুতে গুরুতর চোট পান, যার কারণে তাকে মাঠের বাইরে থাকতে হবে প্রায় দুই মাস। 

তিনি এখনো বিশ্বকাপে খেলার আশা ছাড়েননি, এবং অনেক রিপোর্টে এমনও বলা হয়েছে যে, তিনি তার রিহ্যাবিলিটেশন প্রক্রিয়ায় প্রত্যাশার চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেন, এবং যতই দিন যাচ্ছে, তাকে তার হাঁটুর ব্রেস’টির উপর ততটাই কম নির্ভর করতে হচ্ছে।

২২ বছর বয়সী জেমস থ্রি লায়নস’দের হয়ে ইতিমধ্যে ২২টি ম্যাচ খেলেছেন, এবং কাতারে সেই এপিয়ারেন্স আরো বাড়িয়ে নিতে হলে তাকে অনেকটা অসম্ভবকেই সম্ভব করতে হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।

এনগোলো কান্তে – চেলসি, ফ্রান্স (N’golo Kante – Chelsea, France)

ফ্রান্সের ২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক এনগোলো কান্তে এবারের কাতার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। তার ক্লাব চেলসি’র হয়ে খেলার সময় তিনি একটি গুরুতর ইঞ্জুরিতে আক্রান্ত হোন, যা তাকে এই বিশ্বকাপ আসর থেকে ছিটকে দেয়।

৩১ বছর বয়সী এই সুপারস্টার গত আগস্ট মাসে নিজের হ্যামস্ট্রিং এ আঘাত পেয়েছে ২ মাসের জন্য সাইডলাইনে ছিলেন। পরে আবার সেই একই জায়গায় ব্যথা পাওয়ার কারণে তিনি আরো তিন মাসের জন্য মাঠে নামার অযোগ্য ঘোষিত হোন, যা বিনিময়ে তার আরেকটি বিশ্বকাপ খেলার সকল স্বপ্নই ধুলোয় মিশিয় দেয়।

ফ্রান্সের হয়ে ৫৩ বার মাঠে নামা এনগোলো কান্তে তাদের মিডফিল্ডে একজন অতন্দ্র প্রহরীর কাজই করতেন। এবারের বিশ্বকাপে শুধু তিনিই নন, ফ্রান্সের মিডফিল্ডের আরেক কান্ডারী পল পগবাও ইঞ্জুরির কারণে খেলতে পারছেন না।

ডিয়োগো জতা – লিভারপুল, পর্তুগাল (Diogo Jota – Liverpool, Portugal)

গত মাসে ম্যানচেস্টার সিটি’র বিরুদ্ধে লিভারপুলের ১-০ গোলের জয়ের ম্যাচটির শেষের দিকে একটি গুরুতর কাফ ইঞ্জুরিতে পড়েন পর্তুগিজ সেনসেশন ডিয়োগো জতা। প্রথমে সবাই সেটিকে লিভারপুলের কালক্ষেপণ করার একটি পন্থা ভাবলেও পরে তাকে মাঠ থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্ট্রেচার আনতে হয়। গুরুতর সেই ইঞ্জুরিটিই জতা’কে এবারের বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেয়।

২৫ বছর বয়সী জতা এর আগে পর্তুগালের হয়ে ২৯টি ম্যাচে খেলেছেন, যার মধ্যে তিনি দেশটির হয়ে ১০টি গোলও করেছেন। বিশ্বকাপে তার শূন্যস্থানটি পূরণ করা পর্তুগালের জন্য বেশ কঠিন একটি ব্যাপার হতে চলেছে।

কাইল ওয়াকার – ম্যানচেস্টার সিটি, ইংল্যান্ড (Kyle Walker – Manchester City, England)

ইংল্যান্ড তাদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায়, যখন তাদের ডিফেন্সের কান্ডারী কাইল ওয়াকার টুইটারে পোস্ট দিয়ে সবাইকে জানান যে, তিনি হয়তোবা ইঞ্জুরির কারণে এবারের বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারবেন না।

তার সেই টুইটে তিনি বলেছিলেন, “খেলোয়াড় হিসেবে আমাদেরকে এটি মেনে নিতেই হবে যে, আমাদের প্রানপ্রিয় এই খেলাটির একটি বড় অংশ হচ্ছে ইঞ্জুরি। গত মঙ্গলবার আমার অস্ত্রোপচারটি সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে, এবং এখন আমি আমার সবটুকু মনযোগ দিচ্ছি আমার রিহ্যাবিলিটেশনের উপরেই, যাতে করে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি যেন পূর্ণাঙ্গ ফিটনেস ফিরে পেতে পারি। আমি কাতারে যেতে পারি বা নাই পারি, যেখানেই থাকব, আমি আমার জাতীয় দলের সতীর্থদেরকে সাপোর্ট দিয়ে যাব।”

ওয়াকার হলেন গ্যারেথ সাউথগেট এর সবচেয়ে ভরসাবান খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন, এবং সব ঠিক থাকলে এবারের বিশ্বকাপের শুরু থেকেই তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে মাঠ কাঁপাতেন। কিন্তু, তিনি অনেকটা অসময়েই একটি গ্রইন ইঞ্জুরিতে পড়েন, যার কারণে তাকে অস্ত্রোপচারের সম্মুখীনও হতে হয়। তবে, সর্বশেষ রিপোর্ট অনুসারে জানা যাচ্ছে যে, ওয়াকার খুব দ্রুত গতিতেই সেরে উঠছেন, এবং ইংল্যান্ডের গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচগুলিতে না পারলেও নক আউট পর্বে উঠতে পারলে খেলার সম্ভাবনা রয়েছে কাইল ওয়াকারের।

৩২ বছর বয়সী ওয়াকারের জন্য হয়তো একজন পূর্ণাঙ্গ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ খেলার এটিই সর্বশেষ সুযোগ। এ পর্যন্ত তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে মোট ৭০টি ম্যাচ খেলেছেন।

বেন চিলওয়েল – চেলসি, ইংল্যান্ড (Ben Chilwell – Chelsea, England)

ইংল্যান্ডের সবচেয়ে সাম্প্রতিক ইঞ্জুরি সমস্যাটিও এসেছে তাদের রক্ষণভাগেই। চেলসি’র বেন চিলওয়েল মাত্র কয়েকদিন আগেই একটি হ্যামস্ট্রিং ইঞ্জুরির ভুক্তভোগী হয়েছেন, যার কারণে প্রায় ৩ মাসের মত সময় তাকে সাইডলাইনে কাটাতে হবে। ফলে, এবার বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নটি তাকে ঝেড়ে ফেলতেই হচ্ছে।

দুই সপ্তাহ আগে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগে ডাইনামো জাগ্রেব এর বিরুদ্ধে হোম ম্যাচে চেলসি’র হয়ে লেফট উইং দিয়ে নিজের স্বভাবসুলভ একটি দৌড় দেন বেন চিলওয়েল। শ্বাসরুদ্ধকর সেই দৌড়ের এক পর্যায়ে তিনি হঠাৎ থেমে যান এবং মাটিতে গড়িয়ে পড়েন। প্রথম নজরেই বোঝা গিয়েছিল যে, তিনি তার হ্যামস্ট্রিংয়েই আঘাত পেয়েছেন, এবং তার জন্য সামনে বিপদের ঘনঘটা।

সেদিন তাকে মাঠ থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুইজন এর সাহায্য প্রয়োজন হয়েছিল। এছাড়া, স্টেডিয়াম ছাড়ার সময় তাকে ক্রাচ ব্যবহার করতেও দেখা গিয়েছিল।

বেন চিলওয়েল ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে ১৭টি ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু তার এই দীর্ঘকালীন ইঞ্জুরির মানে হল এই যে, ২৫ বছর বয়সী চিলওয়েল কাতারে গিয়ে ইংল্যান্ডের হয়ে তার ১৮তম ম্যাচটি খেলতে পারবেন না।

Share.

Leave A Reply

Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.