আর্জেন্টিনা ইতিমধ্যে এবারের ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২ এর কোয়ার্টার ফাইনালে নিজেদের স্থানটি পাকাপোক্ত করেছে। গত শনিবার সন্ধ্যায় কাতারের আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের রাউন্ড অব ১৬ তে তাদের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া শেষ মুহূর্তে অনেক চাপ সৃষ্টি করলেও শেষমেষ ম্যাচটি ২-১ গোলে জিতে নিতে সক্ষম হয় আর্জেন্টাইন’রা।

ম্যাচ শেষ হওয়ার ১৫ মিনিট আগে একটি গোল পরিশোধ করার মাধ্যমে সকারুজ খ্যাত অস্ট্রেলিয়ানরা খেলায় ফিরে আসে, এবং ম্যাচের বাকি অংশ জুড়ে সমতাসূচক গোলটি করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। ৯০ মিনিটের পরে তারা একটি অসাধারণ সুযোগও পায় খেলা অতিরিক্ত সময়ে নেওয়ার, তবে আর্জেন্টাইন গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ সেই সুযোগটি দৃঢ় হস্তে দমন করেন, এবং অতিরিক্ত সময়ে খেলা না নিয়েই আর্জেন্টিনা ম্যাচ জিতে যায়।

বিশ্বকাপের রাউন্ড অব ১৬ এর আরেক ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে নিজেদের কোয়ার্টার ফাইনাল স্পটটি চূড়ান্ত করেছে নেদারল্যান্ডস। কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ হতে চলেছে লিওনেল স্কালোনি’র আর্জেন্টিনা।

আর্জেন্টিনা কি পারবে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে? — হ্যাঁ, কেন নয়? (Can Argentina go all the way? – Yes, they can)

এমন একটি দলের বিপক্ষে জয়লাভ করা আসলেও বেশ কঠিনই হবে, যারা কি না এখনও পর্যন্ত টুর্নামেন্টটিতে অপরাজিত রয়েছে। তবে, সেমি ফাইনালে অগ্রসর হওয়া এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ব্যাপারে আর্জেন্টিনা বেশ আত্মবিশ্বাসীই হবে, কেননা সেটিই তাদের অনুপ্রেরণা এবং সাহসিকতার উৎস।

আর্জেন্টিনা সর্বশেষ ফিফা বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল ১৯৮৬ সালে। তাদের সেবারের শিরোপাটি অনুপ্রাণিত হয়েছিল মরহুম কিংবদন্তি ডিয়েগো মারাডোনা’র কৃতিত্বের দ্বারা। ঐ বিশ্বকাপে তিনি আর্জেন্টিনা’র হয়ে প্রত্যেকটি ম্যাচে স্টার্ট করেছিলেন, এবং টুর্নামেন্ট জুড়ে ৫টি গোল ও ৫টি এসিস্ট অর্জন করেছিলেন। তিনি নিজ হস্তে দলটিকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে ভিড়িয়ে দেন। আজ ৩৬ বছর পর, আরেক আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি একই অর্জনের পুনরাবৃত্তি ঘটানো থেকে আর মাত্র ৩টি জয়ের দূরত্বে।

নিজের শেষ বিশ্বকাপে মেসি’র একের পর এক অনবদ্য পারফর্মেন্স (Messi putting on a show at his last World Cup)

নিজের দেশের হয়ে এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় স্টেটমেন্টটি লিওনেল মেসিই তৈরি করেছেন। প্রথমবারের মত, কোন একটি বিশ্বকাপে তিনি প্রবেশ করেছেন এমন একটি দল নিয়ে, যে দলের সকল খেলোয়াড়ই তার নিজস্ব ধ্যান ধারণার উপাসনা করে থাকে। তিনিই দলটির কেন্দ্রবিন্দু। তাকে ঘিরেই নিজেদের খেলা ঝালাই করে নিয়েছেন তার সতীর্থরা। এ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা যে ৪টি ম্যাচ খেলেছে, তার মধ্যে ৩টিতেই গোল ও এসিস্ট করেছেন এই মহাতারকা।

পড়ুন:  ফ্যান্টাসি প্রিমিয়ার লীগঃ এমন ১০ জন খেলোয়াড় যাদেরকে আপনার এখনই দলে নেওয়া উচিৎ

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেসি’র গোলটি ছিল তার ক্যারিয়ারের ১০০০তম সিনিয়র আন্তর্জাতিক ম্যাচে তার ৭৮৯তম গোল। এর মধ্যে ৯টি গোল এসেছে বিশ্বকাপের মঞ্চে। তার এই বিশ্বকাপ গোল ট্যালিতে তিনি নিশ্চয় আরো গোল যোগ করতেই চাইবেন।

বিশ্বকাপের গভীরে পৌঁছানোটাও এই সাত বারের ব্যালন ডি’অর চ্যাম্পিয়নের জন্য নতুন কিছু নয়, কারণ ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে তার দলকে তিনি নিজ হস্তে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন, যদিও অতিরিক্ত সময়ে মারিও গোৎসা’র করা গোলে ম্যাচটি হারতে হয় আলবেসিলেস্তে’দের।

এবার যখন তিনি ৩৫ বছরের কোঠা ছুঁয়েছেন, তখন লিওনেল মেসি তার ক্যারিয়ারের ৫ম ও শেষ বিশ্বকাপে এসে বিশ্বকাপ শিরোপাটি ঘরে তোলার জন্য মরিয়া, কেননা তার অসাধারণ ক্যারিয়ারে শুধুমাত্র এই একটি শিরোপারই কমতি রয়েছে, যা তাকে ডিয়েগো মারাডোনার সমকক্ষ হওয়া থেকেও বাঁধা দিয়ে যাচ্ছে।

এবারের বিশ্বকাপ আসরে প্রবেশের পূর্বে একটানা ৩৬টি ম্যাচে অপরাজিত থাকার বিরল রেকর্ডটি ছিল আর্জেন্টিনার অনুকূলে। তবুও বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলে মর্মান্তিকভাবে পরাজিত হওয়ার পর সকলেই এই গৌরবান্বিত জাতিটির বিশ্বকাপ জেতার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।

ম্যাচটির পর যে ধরণের নেতিবাচকতা দলটিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল, সেটির কথা মিডিয়াতে আসতে বেশি সময় লাগেনি। সেসকল মিডিয়া রিপোর্টের অনেকগুলিতে এমনও জানানো হয়েছিল যে, আর্জেন্টাইন ফুটবলাররা নাকি ভেতর থেকে মৃত অনুভব করছিলেন। তখনই এটি স্পষ্ট হয়েছিল যে, মেক্সিকোর বিপক্ষে তাদের দ্বিতীয় গ্রুপ ম্যাচটি হতে চলেছে বিশ্বকাপে তাদের এ যাবতকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ।

পুরো আর্জেন্টাইন দলটি সেদিন সংঘবদ্ধ হয়ে মাঠে নামে, এবং একটি দূর্দান্ত পারফর্মেন্স উপহার দেয়। সেদিনের ২-০ গোলের জয়টিতে অবশ্য সবচেয়ে মূল্যবান ও মোক্ষম ভূমিকা পালন করেন ঐ মেসিই। এরপর নিজেদের তৃতীয় গ্রুপ ম্যাচে পোল্যান্ডের বিপক্ষে অত্যন্ত সহজ একটি জয় তারা তুলে নেয়, এবং আবারও নিজেদের তালমিল খুঁজে পায় স্কালোনি’র শিষ্যরা।

লিওনেল মেসি ফ্যাক্টর বাদেও আরো বেশ কিছু কারণে আমরা মনে করি যে আর্জেন্টিনা এবারের বিশ্বকাপ শিরোপাটি ঘরে তুলতে পারবে। সেসকল কারণের মধ্যে অন্যতম হল তাদের সুগঠিত কাঠামোসম্পন্ন রক্ষণভাগ।

পরিসংখ্যান বলছে আর্জেন্টিনা বর্তমানে বিশ্বসেরা দলগুলির একটি (Stats show Argentina have been among the best)

চলমান বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ে আর্জেন্টিনা কেবলমাত্র ২টি গোল হজম করে, যা কি না এবারের বিশ্বকাপে যেকোন দলের জন্যই খুবই ভালো একটি সংখ্যা। প্রথম দেখায় হয়তো এই পরিসংখ্যানটিকে খুব বড় কোন ব্যাপার মনে হয় না, তবে অনলাইন আউটলেট এফবিরেফ এ অপ্টা কর্তৃক প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্যায়ে সকল দলের মধ্যে আর্জেন্টিনারই ছিল সবচেয়ে কম এক্সজিএ (এক্সপেক্টেড গোলস এগেইন্সট বা গোল হজম করার সম্ভাবনা)। তাদের জন্য এই সংখ্যাটি ছিল ০.৭, অর্থাৎ প্রত্যেক ম্যাচে তাদের এই সংখ্যক গোল হজম করার সম্ভাবনা ছিল।

পড়ুন:  UEFA ইউরোপা লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল: প্রারম্ভিক পূর্বরূপ এবং ভবিষ্যদ্বাণী

যে দুইটি গোল তারা গ্রুপ পর্বে হজম করেছিল, সেই দুইটি গোলই এসেছিল তাদের প্রথম ম্যাচে, সৌদি আরবের বিপক্ষে। সেই ম্যাচটিতে তাদের একাধিক গোল অফসাইডের কারণে বাতিল ঘোষিত হয়, যার ফলে তাদের এক্সজি (একস্পেক্টেড গোল সংখ্যা বা প্রত্যাশিত গোল সংখ্যা) ০.১ এ নেমে আসে।

গত শনিবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তারা নিজেদের গোলে কেবলমাত্র একটিবারই শট করার সুযোগ দিয়েছিল অজি’দেরকে। সেই ম্যাচে তাদের হোল হজমের সম্ভাবনা ছিল কেবলমাত্র ০.৫টি। যে একটি গোল তারা সেই ম্যাচে কন্সিড করেছিল, সেটি প্রকৃতপক্ষে ছিল এঞ্জো ফার্নান্দেজ এর করা একটি আত্মঘাতী গোল।

তাদের ডিফেন্সকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে যে বিষয়টি সেটি হল বল হারানোর সাথে সাথে তাদের কাউন্টারপ্রেসিং দক্ষতা। তারা দলবদ্ধ হয়ে প্রতিপক্ষের পেছনে হন্যে হয়ে ছোঁটে, এবং নিজেদের সর্বোচ্চটি দিয়ে চেষ্টা করে বল পজিশন ফিরিয়ে নেওয়ার।

যেহেতু মেসি তার দলের ডিফেন্সের দিকটি নিজ হাতে সামলাতে পারেন না, সেহেতু রদ্রিগো দে পল এর মত একজন খেলোয়াড়কে প্রচুর বাহবা দিতে হয়, কেননা মিডফিল্ডে থেকে আর্জেন্টিনা দলের পুরো রক্ষণভাগের তালমিল সামলানোর দায়িত্বটা তিনি বেশ কয়েক বছর ধরেই সাফল্যের সাথে পালন করে চলেছেন।

ডিফেন্স করার সময় তারা সকলেই একে অন্যের জন্য খেলেন, এবং সতীর্থদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা থেকেও পিছপা হোন না। এ কারণেই তারা একটি শক্তিশালী দলে পরিণত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও এ ব্যাপারটি চোখে পড়েছিল, যখন লিসান্দ্রো মার্তিনেজ শেষ মুহূর্তের ট্যাকেল দিয়ে দলকে বাঁচিয়েছিলেন, এবং গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ একদম শেষ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ একটি সেইভ করেছিলেন। ম্যাচশেষে তাদের দলগত উদযাপণ এবং সব মিলিয়ে গত কয়েক বছর ধরে তাদের দলগত ঐক্য ছিল একদম দেখার মত।

মেসি’র জাদুর দিকেও না তাকালেই নয় (Messi’s magic cannot be overlooked as well)

আপনি যখন তাদের ডিফেন্সের অসাধারণ শক্তিমত্তার সাথে আক্রমণভাগে লিওনেল মেসি’র অনবদ্য দক্ষতাকে যোগ করবেন, তখন টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিটস হিসেবে আর্জেন্টিনাকে স্বীকার করে নিতে আপনি বাধ্য হবেন। বিশ্ব ফুটবলের যে পরাশক্তিই তাদের বিপক্ষে খেলতে নামুক না কেন, আর্জেন্টিনাকে ছোট করে দেখার ভুলটি তারা কেউই করতে চাইবে না। 

পড়ুন:  EPLNews এর সাথে ইউরো 2024 ফলো করুন

বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে পরাজিত হওয়ার পরেও বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলার কীর্তি সর্বশেষ ২০১০ বিশ্বকাপে গড়েছিল অনবদ্য স্পেন দলটি। সেই দলটির সাথে বর্তমান আর্জেন্টিনা দলের বহু সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।

সেবারের স্পেন দলের মত এবার আর্জেন্টিনা দলটিও বিশ্বকাপে প্রবেশ করেছে নিজেদের মহাদেশের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। আর্জেন্টিনাকেও এবার অনেকেই বিশ্বকাপের ফেভারিট দল হিসেবে গণ্য করছেন। উভয় দলই বল পজিশন নিজেদের দখলে রাখতে পছন্দ করে, এবং ম্যাচের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে দেয়। এছাড়া, উভয় দল ডিফেন্সের দিক দিয়েও প্রচন্ড শক্তিশালী। উভয় দলই বিশ্বকাপের প্রথম গ্রুপ ম্যাচে একটি বড়সড় অঘটনের শিকার হয়, কিন্তু দৃঢ় মানসিকতার জোড়ে সেই হারের আঘাত থেকে ফিরে আসে।

এছাড়া, উভয় দলই কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার সময় +৪ গোল ব্যবধানের অধিকারী ছিল। স্পেন সেবার এই পর্যায়ে ৫টি গোল করেছিল, এবং হজম করেছিল মাত্র একটি গোল। আর্জেন্টিনা এবার মোট ৭টি গোল স্কোর করেছে, এবং বিনিময়ে হজম করেছে ৩টি। কাকতালীয় ঘটনা? আমরা মনে করি না।

মজার ফ্যাক্টগুলিও আর্জেন্টিনার অনুকূলেই কথা বলে (The fun facts back Argentina as well)

মজার আরেকটি তথ্য হল এই যে, এর আগে যে দুইবার আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিল, ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালের সেই দুই বিশ্বকাপ আসরের তৃতীয় ম্যাচেও যথাক্রমে ম্যারিও কেম্পেস ও ডিয়েগো মারাডোনা একটি করে পেনাল্টি মিস করেন। তারপরেও তারা শিরোপা ঘরে তুলতে পেরেছিলেন। 

আপনি কি অনুমান করতে পারেন এবারের বিশ্বকাপে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে পোল্যান্ডের বিপক্ষে লিওনেল মেসি কি করেছেন? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। তার পেনাল্টি শটটিও প্রতিপক্ষের গোলকিপার সেইভ করে ফেলেন। হয়তো এমন বিশাল এক অপেক্ষার পর এই অত্যধিক প্রতিভাবান দলটিই পারবে তাদের পূর্বজদের অসামান্য সাফল্যের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে। সকল তথ্য উপাত্ত তো সেদিকেই ইশারা করছে!

Share.
Leave A Reply