যদি ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের মত করে আর্জেন্টিনা এবং ক্রোয়েশিয়া এবারের বিশ্বকাপেও গ্রুপ পর্বে একে অপরের মুখোমুখি হতো, তাহলে আমাদের সামনে এই সোজাসাপ্টা প্রশ্নটির একটি সোজাসাপ্টা উত্তর থাকতো।

তবে, কাতারে চলমান এবারের ২০২২ বিশ্বকাপে যেভাবে একের পর এক অঘটন ঘটেই চলেছে, তাতে কোন কিছুই নিশ্চিতরূপে বলাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।

আমরা যা জানি (What we know)

আমরা এখন মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, লিওনেল মেসি তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল ও ফলবান বিশ্বকাপই এবার পার করছেন, এবং যদি আমরা অতীতে ফিফার বিচারবুদ্ধি পর্যালোচনা করে দেখি, তাহলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সেমি ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে কোনরকম হারাতে পারলেই মেসি জিতে নিতে পারবেন এবারের গোল্ডেন বল পুরষ্কারটি।

আমরা এটিও জানি যে, ২০১৮ বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল পুরষ্কার জয়ী ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক লুকা মদ্রিচও এবারের কাতার নিজের দলের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, এবং মেসি মতই তারও অসাধারণ নেতৃত্বের উপর ভর করেই ক্রোয়েশিয়া এ পর্যন্ত বিশ্বকাপে টিকে রয়েছে।

আমরা আরও জানি যে, সকলের প্রত্যাশা মাফিক এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন’দের করা সবকটি গোলের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশিটিতে জড়িত ছিলেন লিও মেসি। তবে, আমরা এটিও দেখেছি যে, ক্রোয়েশিয়াকে টুর্নামেন্টে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে নিজের জাদুকরী টুপির ভেতর থেকে বার বার জাদুকরী খরগোশ বের করেছেন রিয়াল মাদ্রিদ স্টলওয়ার্ট লুকা মদ্রিচ।

৮০,০০০ দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন লুসেইল আইকনিক স্টেডিয়ামে তাই এটি হতে চলেছে দুই এলএম১০ (LM10) এর মধ্যকার লড়াই, এবং মাঠের খেলায় যাই ঘটুক না কেন, গ্যালেরিতে বা বাসায় টিভি সেটের সামনে উপস্থিত সকল ফুটবল প্রেমীরাই একটি অসাধারণ ম্যাচ উপভোগ করতে পারবেন, এ বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই।

ম্যাচটিতে যা যা ঘটতে পারে (How the game could play out)

আর্জেন্টিনা এবারের বিশ্বকাপে নিজেদের খেলা প্রথম ম্যাচটিতে সৌদি আরবের নিকট পরাজিত হয়, এবং তারপর থেকে তারা ২০১০ সালে স্পেনের বিশ্বকাপ জয়ী ধারাটি হুবহু অনুসরণ করতে পেরেছে। সেবার স্পেন নিজেদের প্রথম ম্যাচ হারার পর টুর্নামেন্টের বাকি সবকটি ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলে। বলাই বাহুল্য, সেবারের স্বাগতিক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকাও ছিল এবারের বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশটির মতই বৈচিত্র্যময়।

পড়ুন:  পেলে'র প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ ফুটবলের চেহারা বদলে দেওয়া এক ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির কাহিণী

এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা সেই ম্যাচটিতে অলৌকিকভাবে হারার পর থেকে শুধু যে জয়ের ধারায়ই ফিরেছে তাই নয়, বরং এক ধরণের নব উদ্যমে উদ্দীপ্তও হয়েছে বটে। মেক্সিকো, পোল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মোটামুটি ভালোই খেলে আলবেসিলেস্তে’রা, তবে তাদের সেই অনবদ্য দলবদ্ধতার ছাপ আবারও নজরে পড়ে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে, যারা ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ সেমি ফাইনালের মত এবারও আর্জেন্টিনাকে একদম শেষ পর্যন্ত খাটিয়ে নিয়েছে জয়ের জন্য।

অন্যদিকে, ক্রোয়েশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে অভিজ্ঞ এক ঘোড়া, যারা এবারের কাতার বিশ্বকাপ ২০২২ এ আর্জেন্টিনার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় কঠিন প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছে। তারা একটানা দুইটি ম্যাচে হারার পজিশন থেকে ফিরে এসে খেলা পেনাল্টি শুট আউটে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়, এবং উভয় ক্ষেত্রেই পেনাল্টি শুট আউটে জয়ী হতে সক্ষম হয়।

এবারের এই সেমি ফাইনাল ম্যাচটি হবে দু’দলের মধ্যকার একটি মানসিক লড়াই, যার ফলাফল নির্ধারিত হবে ইচ্ছাশক্তির বিচারে। ম্যাচটি জুড়েই থাকবে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনার মুহূর্ত, এবং খেলোয়াড়দের মধ্যে বাক-বিতন্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা। তবে, তার মধ্যেও আমরা লিওনেল মেসি এবং লুকা মদ্রিচের কিছুটা জাদু দেখতে পাব বলে আশা করাই যায়।

মেসি কি পারবেন এই বাঁধাটি টপকাতে? (Will Messi prevail?)

এই প্রশ্নটির ক্ষেত্রে আমাদের উত্তর হল “হ্যাঁ”। এর পেছনের কারণগুলি হল নিম্নরূপঃ

পুরো আর্জেন্টিনা দলটিই মেসি’র জন্য খেলছে ২০১৪ এবং ২০১৮ উভয় বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনা দলটি ছিল সম্পূর্ণভাবে মেসিনির্ভর। তার অসাধারণ ক্রীড়ানৈপূণ্যের জোড়েই সেই দুইবার তারা একটি পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছিল। তবে, এবারের আর্জেন্টিনা দলটি যে শুধু তাকে কেন্দ্র করেই তৈরি করা হয়েছে তাই নয়, বরং দলটি গঠনের পেছনে একটি অসাধারণ কাঠামো ও পরিকল্পনাও রয়েছে কোচ স্কালোনি’র।

দলের কেন্দ্রবিন্দু সেই মেসি হলেও তার সাথে দলের অন্যান্য সকল খেলোয়াড়দেরই রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও বোঝাপড়া। তারা সকলেই এই কিংবদন্তি ফুটবলারটিকে সাফল্য এনে দেওয়ার লক্ষ্যেই খেলে চলেছেন বলেই মনে হচ্ছে।

পড়ুন:  আর্সেনালের খেলোয়াড়রা কি অফ-সিজনে প্রিমিয়ার লিগের অন্যান্য দল দ্বারা অভিযান চালাবে?

আর্জেন্টিনার নিকট এখন রয়েছে উন্নতমানের কিছু ফিনিশার ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্সের কোনই তুলনা হয় না, তবে আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগ নিঃসন্দেহে ক্রোয়েশিয়ার আক্রমণভাগের থেকে বেশ কয়েকগুণে শ্রেয় পারফর্মেন্স উপহার দিয়ে আসছে। ইচ্ছাশক্তির জোড়ে ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্স আর্জেন্টিনার এই আক্রমণভাগকে নিষ্ক্রিয় করে দিতেই পারে, তবে ক্রোয়েশিয়ার একটি ভুলই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে, কেননা আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড’রা এতটাই সজাগ ও কার্যকর।

আরেক দিক থেকে দেখলে, ভাগ্য অতিমাত্রায় সহায় না হলে গোল করার জন্য ক্রোয়েশিয়ার প্রয়োজন হবে বেশ কিছু সুযোগের, যা আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডাররা তাদেরকে খুব সহজে নিশ্চয় দিবেন না।

Share.
Leave A Reply