যেকোন ফুটবল টুইটার একাউন্টের মত শোনালেও আজকে আমাদেরকে বলতেই হচ্ছে যে, হ্যাঁ, সত্যিই লিওনেল মেসি একটি বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছেন। 

পাঁচবারের চেষ্টায় তিনি সেটি করতে পেরেছেন। একটু দেরিতে হলেও তিনি তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন শিরোপাটি ঘরে তুলতে পেরেছেন। এবং, বহুদিন ধরে চলে আসা মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি বিতর্ক এখন আবার আরেকটি নতুন দিশা পেয়েছে, যার মূল কারণই হল গত ১৮ই ডিসেম্বর কাতারের লুসেইল আইকনিক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপ ফাইনাল। 

এছাড়াও, এই শিরোপাটি জেতার মধ্য দিয়ে তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে গণ্য হওয়া থেকে আর মাত্র একটি শিরোপার দূরত্বে পৌঁছে গিয়েছেন।

এই পর্যায়ে এসে আপনি এই নিবন্ধটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতেই পারেন, কারণ এই নিবন্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে একটি শব্দই বার বার ফিরে আসে “সর্বকালের সেরা” (GOAT – Greatest Of All Time)।

তবে, এই গোট বিতর্ক নিয়ে কিছু দিক খোলাসা করা দরকার, এবং সেটি করাই হল আমাদের এই নিবন্ধটির মূল উদ্দেশ্য।

এ পর্যন্ত লিওনেল মেসি (Messi over the years)

এফসি বার্সেলোনার হাত ধরে মাত্র ১৩ বছর বয়সেই দক্ষিণ আমেরিকান দেশ আর্জেন্টিনা থেকে ইউরোপে পাড়ি জমান “রোজারিও থেকে আসা ছোট্ট বালক” হিসেবে পরিচিত লিওনেল মেসি। বার্সেলোনাই সে সময় এমন একমাত্র দল ছিল যারা কি না তার মধ্যে সেই অগাধ সম্ভাবনাটি দেখতে পেয়েছিল, এবং তাকে সেসকল সুযোগ সুবিধাই দিয়েছিল যা একজন বয়ঃসন্ধিকালীন ফুটবলারকে দেওয়া প্রয়োজন। 

আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের ক্লাব নিউয়েল’স ওল্ড বয়েজ থেকে নিয়ে এসে আর্জেন্টাইন স্বর্ণবালক লিওনেল মেসি’র উপর বার্সেলোনা বিনিয়োগও করে। সেই বিনিয়োগ মোটেও অপচয় হয়নি, কেননা বার্সেলোনার লা মাসিয়া একাডেমি থেকে উঠে আসা সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড় হলেন মেসিই। 

মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি বার্সেলোনার মূল একাদশে অভিষিক্ত হোন, এবং মাঠে নেমেই তিনি সকলের নজর কাড়েন। যারাই তার খেলা দেখেছেন, তাদের সকলেই তার সম্পর্কে প্রশংসার গান গেয়েছেন। এরপর খুব শীঘ্রই আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে ডাক পান তিনি, এবং সেখানে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিতে তার খুব বেশি সময় প্রয়োজন হয়নি।

পড়ুন:  ২০২২-২৩ মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগে এএফসি বোর্নমাউথের টিকে থাকার সুযোগ নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ

প্রায় দুই দশক পরে, আজ মেসি একজন ভেটেরান ফুটবলারে পরিণত হয়েছেন, যার নিকট ব্লগরানা’র বার্সেলোনা এবং আর্জেন্টিনার আলবেসিলেস্তে’দের হয়ে রয়েছে অসংখ্য শিরোপা ও গৌরব। 

তিনিই হলেন আর্জেন্টিনার হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলদাতা, আবার তিনিই হলেন দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবল ইতিহাসের এবং স্প্যানিশ লা লীগা’রও সর্বোচ্চ গোলদাতা। তার নিকট রয়েছে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ এপিয়ারেন্স এর রেকর্ডও। আপনি এই দুই দল সংক্রান্ত যেকোন রেকর্ড বই বা তালিকা দেখলেই বুঝতে পারবেন যে, নিশ্চিতরূপে লিওনেল মেসি সেসকল বই বা তালিকার প্রথম পেজেই রয়েছেন। সবার উপরে, স্বর্ণাক্ষরে তার নামটি লিখা রয়েছে।

এখন, ক্যারিয়ারের সন্ধিক্ষণে, অবসরের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে তিনি ফ্রেঞ্চ ধনকুবের ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেই’তে খেলছেন, এবং কুদরতের কি খেল! এত বছর বার্সেলোনায় খেলার পর এবং ক্লাব ফুটবলের সম্ভাভ্য সকল শিরোপা জেতার পর, মেসি তার সবচেয়ে প্রিয় শিরোপাটি, অর্থাৎ বিশ্বকাপ শিরোপাটি জিতলেন এসে পিএসজি’র খেলোয়াড় থাকাকালীন।

গোট (GOAT) সংক্রান্ত বিতর্ক (The GOAT debate)

এই বিতর্কটি যতই বিনোদনমূলক হোক না কেন, অনেকের জন্যই শেষমেষ এই বিতর্কটির কোন সুরাহাও নেই, তাই কোন অর্থও নেই।

যারা এই বিতর্কে মেসি’র বিপক্ষে, তারা মেসি’র গোল ট্যালিকে, শিরোপা ট্যালিকে, রেকর্ডের বাহুল্যকে, এমনকি তাকে যে বিশ্বের লাখো কোটি ফুটবল প্রেমী জনতা হৃদয়ে ধারণ করে সেটিকেও অগ্রাহ্য করেন।

এই ক্যাটেগরি’র ফুটবল ভক্তরা মনে করেন যে, লিওনেল মেসি নতুন কিছুই অর্জন করতে পারেননি, এবং যেসব কীর্তি তিনি গড়েছেন, তা তার আগে অন্য কেউ তার চেয়েও ভালো উপায়ে গড়ে গিয়েছেন। এবং এই ক্যাটেগরির মধ্যে আরেকটি সাবসেট হল সেসকল সমর্থক যারা মনে করেন যে, মেসি’র একমাত্র চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, যিনি কি না শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে মেসি’র থেকে অনেক ধাপ এগিয়ে। 

যখন প্রথম মেসিকে গোট বিতর্কে সামিল করা হয়েছিল, তখন তার তুলনা দেওয়া হয়েছিল পেলে ও মারাডোনা’র মত কিংবদন্তি’দের সাথে, যারা কি না ছিলেন দুইজন যুগান্তকারী ফুটবলার, যাদের খেলা দেখে ফুটবলের প্রেমে পড়েছে পুরো দুনিয়া। গোলের সামনে তার দক্ষতা ও ক্ষমতার তুলনা দেওয়া হয়েছিল পেলে, জোসেফ বিকান, এবং ফেরেঙ্ক পুস্কাস’দের সাথে। সাথে সাথে তার প্লেমেকিং দক্ষতাকেও তুলনা করা হয় বিশ্বের সেরাদের সাথে, তা তারা বর্তমানেরই হোক, বা অতীতের। 

পড়ুন:  প্রিমিয়ার লীগ ২০২২-২৩ঃ সদ্য প্রমোটেড বোর্নমাউথ, ফুলহ্যাম এবং নটিংহ্যাম ফরেস্টের দিকে প্রথম নজর

এবং, যখন একটি গোষ্ঠী এই মহামানবকে তার প্রাপ্য ফুলগুলি দেওয়ার কথা ভাবছিলেন, তখন আরেক গোষ্ঠী সেই ফুলগুলি কেড়ে নিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। তবে, তাদের সেই বাছাইয়ের পেছনে মূল কারণটিই হল নিজস্ব পছন্দ, এবং আবেগ।

এই ক্যাটেগরি’র ফুটবল ভক্তদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে হলে তাদের সামনে শুধুমাত্র এবারের কাতার বিশ্বকাপে লিওনেল মেসি’র গড়া নতুন নতুন সব রেকর্ডের তালিকাটি তুলে ধরতে হবে। 

  • বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ এবং সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে একই ম্যাচে গোল এবং এসিস্ট করা।
  • একটি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ সংখ্যক গোল ইনভলভমেন্ট অর্জনকারী খেলোয়াড়।
  • প্রথম এবং একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে পাঁচটি বিশ্বকাপে এসিস্ট প্রদানের কীর্তি।
  • বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ সংখ্যক এপিয়ারেন্স মেকার।
  • প্রথম এবং একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে দুইবার বিশ্বকাপের প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট (এডিডাস গোল্ডেন বল) জেতার গৌরব। 

  • বিশ্বকাপে কোন দলের অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক এপিয়ারেন্স।
  • বিশ্বকাপের নক আউট পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক এসিস্ট (সম্মিলিতভাবে)।
  • বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরষ্কার জয়।

কিন্তু, তারপরও এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা এসকল রেকর্ড দেখার পরেও, নিজেদের বক্তব্য পরিবর্তন করবেন না, বরং যুক্তিসহ বা আবেগের বশে বিতর্ক চালিয়েই যাবেন। তারা যে/যেসকল খেলোয়াড়/খেলোয়াড়দেরকে সাপোর্ট দিয়ে আসছেন, তারা এই বিতর্কে ঘুরে ফিরে তাদের দলেই যোগ দিবেন। 

এসবের মানে আসলে কি?

সহজ ভাষায় এর মানে হচ্ছে যে, এই গোট বিতর্কের তেমনি কোন অন্ত নেই, ঠিক যেমনি মেসির অসাধারণ ক্যারিয়ারের সাথে তুলনা দেওয়ার মত ক্যারিয়ারও কারো নেই।

তবে, এখানে কঠিন হলেও সত্য এই যে, কাতার বিশ্বকাপ ২০২২ এর ফলাফলের পর এটি অনেকটা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে যে যদি দূর বা অদূর ভবিষ্যতে এই গোট বিতর্কের কোন যুক্তিসঙ্গত উপসংহার টানতে হয়, তাহলে মেসিকেই এই উপাধিটি প্রদান করা যেতে পারে।

প্রশ্নের জবাবঃ মেসি’র লেগ্যাসি আসলে কি? (Answer to the question: What is Messi’s legacy?)

মেসি যখন অবসরে যাবেন, তখন তিনি তার উত্তরাধিকারদের জন্য কি রেখে যাবেন?

পড়ুন:  ক্লপের অধীনে কীভাবে লিভারপুল তাদের মৌসুম ঘুরে দাঁড়ায়

অসংখ্য সেসব গোল, এসিস্ট, শিরোপা এবং ব্যক্তিগত পুরষ্কার অর্জনের পর, এবং পূর্ববর্তী সেকশনে আলাপ সাপেক্ষে গোট বিতর্কে মেসি’র জয়জয়কারের পর এটি অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, মেসি তার পরের প্রজন্মের জন্য খুবই কঠিন পদচিহ্ন ছেড়ে যাবেন।

আসুন, একটু বিশ্লেষণ করা যাক।

২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনালে শিরোপার দৌড়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে লড়াই করে আলবেসিলেস্তে’রা। দুই পিএসজি সতীর্থ মেসি এবং এমবাপ্পে’র মধ্যকার দ্বৈরথটি এমন ছিল যেন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে মশাল আদান প্রদান চলছে। 

এক পর্যায়ে, এমবাপ্পে, যাকে কি না নতুন প্রজন্মের পথ প্রদর্শক মানা হচ্ছে, প্রায় মেসি’র মাথা থেকে মুকুটটি খুলে নিজের মাথায় পড়েই ফেলেছিলেন। তার হ্যাট্রিকটি ছিল ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর থেকে কোন বিশ্বকাপ ফাইনালের সেরা পারফর্মেন্স। তবে, মেসি মাঠের অন্যান্য বিভিন্ন এলাকায় নিজের পারদর্শীতা প্রদর্শন করে তার পিএসজি সতীর্থকে জানিয়ে দেন যে কে এখনো ফুটবল মাঠের রাজা।

বিশ্বকাপ শেষ হবার পর এখনও অবশ্য এমবাপ্পে মাথা উঁচিয়েই চলতে পারবেন। এমনকি, গত বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমে তিনি পেলে’র পর সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিলেন। সেবারের যাত্রায় তিনি মেসি ও আর্জেন্টিনাকেও তুলোধুনো করেছিলেন। তবে, এবারের বিশ্বকাপে আরো অভিজ্ঞ একজন মেসির মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে, বিশ্বসেরা হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে তাকে আরো কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

একবার ভেবে দেখুন, সেসকল খেলোয়াড়েরা যারা মেসি বা এমবাপ্পে’র মত প্রতিভাবান নন, তাদের মানসিক পরিস্থিতি কেমন হতে পারে।

লিওনেল মেসি এত উঁচুতে বার স্থাপন করেছেন যে, তিনি অবসর নিলে খেলা হিসেবে ফুটবল বহু অনুসারী হারাবে, কারণ খেলাটি অবেক একপেশে হয়ে পড়বে। তার অসংখ্য অর্জনের চেয়ে বেশি এই ব্যাপারটিই তার লেগ্যাসি হয়ে থেকে যাবে।

তিনি হলেন প্রকৃতির এমন এক জাদুকরী কারিশমা, যার কারণে খেলা হিসেবে ফুটবল একটি অন্য পর্যায়ে পৌঁছেছে, কিন্তু যার বিদায়ের ফলে খেলাটি ঠিক একই পরিমাণ সৌন্দর্য হারাবে।

Share.
Leave A Reply