যা যা থাকছে (Table of content)

  • পেলে’র শেষ মুহূর্তগুলো
  • ফিরে দেখাঃ পেলে’র লেগ্যাসি
  • পেলে’র পরিসংখ্যান ও অর্জনগুলির দিকে এক নজর
  • ফুটবলের চেহারা যেভাবে পরিবর্তন করেছিলেন পেলে
  • পেলে’র অর্জন সম্পর্কে বিখ্যাত ব্যক্তিদের উক্তি
  • শেষ বক্তব্য

ফুটবল বিশ্ব তার একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রকে নিয়ে উদযাপন করার কয়েক দিনের মাথায়ই আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে হারানোর কষ্টে কাতর হয়ে পড়েছে।

এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো, যাকে সারা বিশ্ব পেলে নামে চেনে এবং ভালোবাসে, কোলন ক্যান্সারের সাথে বহুদিন লড়াই করার পর শেষ পর্যন্ত হার মেনেছেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তার মৃত্যুর শোকে এখনো জর্জরিত তার প্রানপ্রিয় পরিবার, পুরো ব্রাজিল রাষ্ট্র, এবং সারা ফুটবল বিশ্ব।

বলা যায়, ২০২০ সালে করোনা মহামারী আক্রমণ করার পর থেকেই একটু একটু করে পুরো বিশ্ব তার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। সে সময়েই অনেক মিডিয়া আউটলেট রিপোর্টও করেছিল যে, পেলে’র শারীরিক অবস্থা অনেকটা খারাপের দিকে।

সেই রিপোর্টগুলি অবশ্য তারা একটু বেশিই (২ বছর) আগে দিয়ে ফেলেছিলেন মনে হচ্ছে, কেননা ২০২২ সালের ২৯ই ডিসেম্বরে এসে পেলে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

যে মানুষটি তার বিচিত্র খেলার ধরণ দিয়ে পুরো বিশ্বের কাছে খেলা হিসেবে ফুটবলকে পরিচিত করেছিলেন, সেই মানুষটি আজ আর নেই। আমরা এখন শুধু যা করতে পারি, তা হল তার জীবনের দিকে ফিরে তাকানো।

চলুন, ফুটবলের রাজা পেলে’র জীবন এবং ক্যারিয়ারের দিকে আরেক নজর দিয়ে আসা যাক, যাকে কি না পরিসংখ্যান সহ বা পরিসংখ্যান ব্যতীত ফুটবলের সর্বকালের সেরা গণ্য করা যায়।

ফিরে দেখাঃ পেলে’র লেগ্যাসি (What is Pele’s legacy?)

এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো এমন একটি সময়ে ফুটবল পাগল দেশ ব্রাজিলে জন্মগ্রহণ করেন, যখন এমনটি মনে হচ্ছিল যে, একটি খেলা হিসেবে ফুটবল কেবলমাত্র বিনোদনের একটি উৎস থেকেও বড় কিছুতে পরিণত হতে পারে।

তিনি শুধুমাত্র ফুটবলের একজন প্রেমিক থেকে দেখতে না দেখতেই একজন খেলোয়াড়ে পরিণত হয়ে যান, এবং খুব কম সময়ের মধ্যেই ব্রাজিল ফুটবল তাকে “দ্য নেক্সট বিগ থিং” বলে ঘোষণা করে, যিনি কি না ফুটবলকে বিনোদনের থেকেও বড় কিছু বানাতে সাহায্য করতে পারেন। এরপর, খুব জলদিই তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার দেশের হয়ে খেলতে শুরু করেন, এবং অনেক কম সময়ের মধ্যেই তিনি বিশ্বকাপ পর্যায়েও নিজের নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে ফেলেন।

পড়ুন:  প্রিমিয়ার লীগে ফ্লপ খাওয়া সবচেয়ে দামী আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়েরা

পেলে’র আগে ও পড়ে প্রচুর ফুটবলীয় জাদুকর এসেছেন এবং চলেও গিয়েছেন, যার মধ্যে একজন হলেন লিওনেল মেসি, যার বিশ্বকাপ জয়কে পুরো বিশ্বই উদযাপন করেছে মাত্র কয়েকদিন আগেই। তবে, ফুটবলের একমাত্র রাজা এবং রাজকীয় রক্ত হিসেবে পুরো বিশ্ব সবসময় এই পেলেকেই স্মরণ করবে।

যেকোন খেলাতেই রাজার মুকুটটি অর্জন করা যেকোন খেলোয়াড়ের জন্যই খুব কঠিন ও গর্বের একটি বিষয়। তবে, পেলে ফুটবলের মাধ্যমে অনেক রাষ্ট্রকে এক করেছেন, ফুটবলের নিন্দুকদেরকে ফুটবল প্রেমী বানিয়েছেন, এবং তার ফুটবলীয় ক্যারিয়ারে অসংখ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে এই উপাধিটি পেয়েছেন।

তার লেগ্যাসিটিই এমন যে, কোন খেলোয়াড়কে বিশ্বসেরা হিসেবে ঘোষণা করতে হলে প্রথমে তাকে পেলে’র সাথে তুলনা করা হয়, তারপরে গিয়ে বোঝা যায় যে, সেই খেলোয়াড় সেই পুরষ্কার বা উপাধিটির যোগ্য কি না।

পেলে’র রেকর্ড, পরিসংখ্যান, এবং অর্জনসমূহ (Pele’s records, stats, and achievements)

  • ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি তিনটি বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছেন।
  • প্রথম টিনেজার (এখন পর্যন্ত দুইজনের মধ্যে একজন) হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করার গৌরব অর্জনকারী।
  • ফুটবলের ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড়, যাকে একটি সম্মানজনক ব্যালন ডি’অর প্রদান করা হয়েছে।
  • একটি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক এসিস্ট প্রদানকারী (১৯৭০ বিশ্বকাপে, ৭টি)।
  • সসর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাট্রিক (১৯৫৮ বিশ্বকাপ)।
  • সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি (মাত্র ১৭ বছর বয়স, ১৯৫৮ বিশ্বকাপ)।
  • ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হ্যাট্রিক (৯২টি অফিশিয়াল হ্যাট্রিক)।
  • যেকোন দক্ষিণ আমেরিকান খেলোয়াড়ের জন্য সবচেয়ে বেশি ম্যাচপ্রতি গোলের অনুপাত (ব্রাজিলের হয়ে ৯২টি ম্যাচ খেলে ৭৭টি গোল)।
  • কোন টপ ফ্লাইট লীগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার গৌরব অর্জনকারী (ব্রাজিলিয়ান সিরি আ’তে স্যান্টোস এর হয়ে ৫৬০টি ম্যাচ খেলে ৫৪১টি গোল)।
  • একই ক্যালেন্ডার বছরে সর্বোচ্চ গোলদাতা (১৯৫৯ সালে ১২৭টি এবং ১৯৬১ সালে ১১০টি — এর মধ্যে আন-অফিশিয়াল গোলও অন্তর্ভুক্ত)।
  • ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ক্যারিয়ার গোল (অফিশিয়াল ফ্রেন্ডলি এবং যুবা পর্যায়ের ম্যাচ ধরে ১৩৬৩টি ম্যাচে মোট ১২৭৯টি গোল)।
পড়ুন:  গেমসপ্তাহ 34 এর জন্য FPL সেরা বাছাই

এখানে উল্লেখিত বেশির ভাগ পরিসংখ্যানই সংখ্যাভিত্তিক, তবে চোখের দেখায় পেলে’র খেলায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতেন তখনকার দর্শকরা। ইংলিশ ফুটবলের অন্যতম কিংবদন্তি, স্যার ববি মুর, একবার বলেছিলেন যে, পেলে’র কোন দূর্বলতাই নেই। এখনকার যুবা খেলোয়াড়েরা অনুপ্রেরণার জন্য আধুনিক খেলোয়াড়দের দিকেই তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু সুন্দর ফুটবলের জনক হিসেবে পেলে আজীবন অমর হয়েই থাকবেন।

কিভাবে পেলে ফুটবলের মাধ্যমে পৃথিবীর হুলিয়া বদলেছেন? (How did Pele change the world with football?)

পেলে’র প্রভাব শুধুমাত্র খেলার মাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন সেই সত্যিকারের রাজা, যিনি তার খেলা দিয়ে সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ তো করতেনই, পাশাপাশি অনেক সমাজসেবামূলক কাজও, যেগুলি তার কাছে ঠিক মনে হত, তিনি করতেন।

একবার তো পেলে নিজ হস্তে একটি পুরো যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিলেন।

১৯৬৯ সালে, গ্রেইট ব্রিটেন এর নিকট হতে স্বাধীনতা অর্জন করার মাত্র ১০ বছর পর, নাইজেরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সশস্ত্র বাহিণীর মধ্যে একটি যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। সেটিকে নাইজেরিয়ার সিভিল ওয়ার হিসেবেই গণ্য করা হয়।

স্যান্টোস তখন সাহসীকতার সাথে সে দেশে একটি এক্সিবিশন ম্যাচের আয়োজন করে, যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল দেশটির সবচেয়ে জনবহুল শহর লাগোসে। অবশ্যই, সেই ম্যাচটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিলেন পেলে নিজেই।

তার আগমণের বার্তা পেয়ে যুদ্ধের উভয় পক্ষ ৪৮ ঘন্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে, কেননা তারা সকলেই চেয়েছিলেন ফুটবলের রাজা পেলে’র পায়ের জাদু দেখতে। ফুটবলের জাদুতেই সেই যুদ্ধবিরতি আরো কয়েক দিন চালু থাকে, কারণ সে সময় যুদ্ধের উভয়পক্ষকেই পুরোপুরিভাবে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তাগিদ দিতে থাকে পুরো ব্রাজিলিয়ান দল।

যদিও তার পরেও নাইজেরিয়ার সিভিল ওয়ার আরো এক বছর চালু ছিল, তারপরও যুদ্ধটি তাড়াতাড়ি দমিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে পেলে ও ব্রাজিলের অনেক বড় ভূমিকা ছিল। ফুটবলের জন্য সেটি ছিল একটি স্মরণীয় মুহূর্ত। পুরো বিশ্বের জন্যও সেটি ছিল একটি চোখ খুলে দেওয়ার মত ঘটনা, কেননা তখনই প্রথম সবাই বুঝতে পেরেছিল যে, একটি যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার মত ক্ষমতাও রয়েছে এই সুন্দর খেলাটির।

এই কীর্তির কারণে গ্রেইট ব্রিটেন এর রাণীর হাত থেকে সম্মাননাস্বরূপ “নাইট” উপাধি পান পেলে। ইংল্যান্ড ও ইউরোপের বাইরের খুব কম মানুষই এই সম্মাননাটি অর্জন করতে পেরেছেন।

পড়ুন:  প্রিমিয়ার লিগে শেফিল্ড ইউনাইটেড থেকে কী আশা করা যায়

আপনি পেলে’র প্রতি বিশ্বের ভালোবাসা ও সম্মান সম্পর্কে নিমিশেই ধারণা পেয়ে যাবেন, যদি দেখেন তার মৃত্যুর পর পৃথিবীর কত দেশ ও সরকারের কাছ থেকে তার পরিবার শুভকামনা পেয়েছে।

ইয়োগা বোনিতো — দ্য বিউটিফুল গেইম — হল একটি বৈশ্বিক আন্দোলন, এবং পেলে হলেন তার অবিসংবাদিত নেতা।

পেলে’র অর্জন সম্পর্কে বিভিন্ন উক্তি (Quotes about Pele’s achievements)

এখানে পেলে’র নিজের এবং তার অর্জনসমূহ সম্পর্কে বিশ্বের অনেক নামকরা ব্যক্তিদের কিছু উক্তি তুলে ধরা হলঃ

“বিটহোভেন যেমন সংগীত রচনার জন্য জন্মেছিলেন, এবং মাইকেল এঞ্জেলো যেমন চিত্রাঙ্কন করার জন্য জন্মেছিলেন, ঠিক তেমনি আমি ফুটবল খেলার জন্য জন্মেছি।”

— ফিফা’র ওয়েবসাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পেলে নিজে

“পৃথিবীর আনাচে কানাচে যত যুবা খেলোয়াড় ফুটবল খেলেন, তাদের সকলেই পেলে হতে চান। একজন কিংবদন্তি হিসেবে আমার দায়িত্ব হল তাদেরকে শুধু এটি শেখানো নয় যে কিভাবে ফুটবল খেলতে হয়, বরং এটিও যে কিভাবে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে হয়।”

— ১৯৯৯ সালে স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড’কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে পেলে

“মহাবিশ্বের সবকিছুই একটি খেলার অংশ। সবকিছুরই শেষ আছে। সবকিছুরই মৃত্যু অবধারিত। আমাদের সকলের ইতিই একই রকম। তাই নয় কি?”

— ১৯৭৭ সালে পেলে

“পেলে খেলার মাঠে যা যা করতেন তার মধ্য দিয়ে তিনি সারা বিশ্বের কাছে ফুটবলকেই তুলে ধরতেন।”

— মারিও জাগায়ো (১৯৫৮ ও ১৯৬২ বিশ্বকাপে ব্রাজিল জাতীয় দলে পেলে’র সতীর্থ, এবং ১৯৭০ বিশ্বকাপে ব্রাজিল জাতীয় দল ও পেলে’র কোচ)

“পেলেই ছিলেন একমাত্র এমন ফুটবলার যিনি খেলার মাঠে যুক্তিকে হার মানাতেন।”

— আধুনিক ফুটবলের জনক ইয়োহান ক্রুইফ

উপসংহার (Conclusion)

পেলে আর নেই, তবে তার স্মৃতি পৃথিবীর বুক থেকে এত সহজে মিটবে না।

ফুটবলের মানচিত্রে তার ছাপ থেকেই যাবে, এবং ফুটবলের সকল অনুসারীদের হৃদয়ে তার নামটি থেকেই যাবে। তার কীর্তি অবলোকন করতে পারায় আমরা সকলেই অনেক ভাগ্যবান। অপারে ভালো থাকবেন, লিজেন্ড। ফুটবলের জয়ের দিনে আপনার গগণবিদারী হাসি আমরা সকলেই অনেক মিস করব।

Share.
Leave A Reply