...

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বর্তমানে একটি চমৎকার অপরাজিত ধারায় অবস্থান করছে। বিশ্বকাপের বিরতির পর প্রিমিয়ার লীগ পুনরায় শুরু হওয়ার পর থেকে তারা কোন ম্যাচই হারেনি, এবং এই যাত্রায় তারা অসংখ্য আশা জাগানিয়া পারফর্মেন্সও উপহার দিয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র মৌসুমের অর্ধেকটাই শেষ হয়েছে, তবে ইতিমধ্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড অনেকেরই মন জয় করে নিয়েছে।

এবারের মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগে সর্বমোট ১৮টি ম্যাচ খেলে ম্যান ইউনাইটেড ইতিমধ্যে ১২টি জয় হাসিল করে নিয়েছে। অর্থাৎ, গড়ে তারা ম্যাচপ্রতি ২ পয়েন্টেরও বেশি করে অর্জন করেছে। আপনি যদি গত নৌসুমে তাদের পরিসংখ্যানের সাথে এবারের নম্বরগুলির তুলনা করেন, তাহলে পার্থক্যটা খুব ভালো করেই বুঝে যাবেন। গত মৌসুমের পুরোটা জুড়ে ইউনাইটেড মোট ১৬টি ম্যাচ জিততে সক্ষম হয়েছিল, এবং ম্যাচপ্রতি গড় পয়েন্ট তাদের ছিল ১.৫ এর আশেপাশে। তেন হাগের শিষ্যরা এবার ক্লাবটির গত মৌসুমের ট্যালিকে বেশ সহজেই পেরিয়ে যেতে পারবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যানেজার হিসেবে নিজের প্রথম মৌসুমের কেবলমাত্র অর্ধেকটাই পার করেছেন তেন হাগ। এই নিবন্ধটিতে আমরা এ পর্যন্ত তার যাত্রাটিকে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করতে চাই, এবং তার বিভিন্ন অর্জনকে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।

একটি অশুভ সূচনাকে উতরিয়ে ওঠার গল্প (Overcoming a difficult start)

প্রাক মৌসুম প্রস্তুতিতে লিভারপুলকে ৪-০ গোলে হারানোর পর এবং অসাধারণ প্রস্তুতি গ্রহণ করার পর, একটি নতুন উদ্যম নিয়েই নতুন মৌসুমটি শুরু করে রেড ডেভিলরা। যদিও সেটি প্রি-সিজনই ছিল, তারপরও সেখানে নিজেদের ক্লাবের একেকটি সংঘবদ্ধ পারফর্মেন্স দেখে বেজায় খুশি হতে শুরু করেছিল ইউনাইটেড সমর্থকরা। সেটি তাদেরকে আরী সাহস ও উদ্দীপনা জোগায় ঠিকই, কিন্তু পুরো কাজটা যে তার থেকে অনেকগুণ বেশি কঠিন।

তবে, মৌসুম শুরু হওয়ার পর মনে হচ্ছিল যে, এ যেন সেই গত ১০ বছরের চিরাচরিত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডই, যারা লীগ শিরোপার ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারছে না ইদানিং। মৌসুমের প্রথম প্রিমিয়ার লীগ ম্যাচেই তারা গ্রাহাম পটারের ব্রাইটন এন্ড হোভ এলবিয়ন এর কাছে ২-১ গোলে ধরাসয়ী হয়। সেই পরাজয়টিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মধ্যে সেসকল বাজে বৈশিষ্ট্যই পরিলক্ষিত হয়েছিল, যা তারা গত মৌসুমেও প্রদর্শন করেছিল। প্রি সিজন থেকে মূল সিজনে আনা আত্মবিশ্বাস মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে যায়।

পরের সপ্তাহে, ইউনাইটেড পাড়ি জমায় ব্রেন্টফোর্ডের মাঠ জি-টেক কমিউনিটি স্টেডিয়ামে, যেখানে তারা আরো বেশি লজ্জার শিকার হয়। এবার তারা ৪-০ গোলের ব্যবধানে ধরাসয়ী হয়, এবং সেই ফলাফলটির পরেই তেন হাগের জন্য এলার্ম বেল (সতর্কতা ধ্বনী) বাজতে শুরু করে দেয়। প্রথম কোন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ম্যানেজার হিসেবে মৌসুমের প্রথম দুইটি ম্যাচেই। ঐ দুই ফলাফলের উপর ভিত্তি করে অনেকেই বলেছিল যে, ইউনাইটেডের মৌসুম সেখানেই শেষ, আর সাথে সাথে তেন হাগেরও।

ব্রেন্টফোর্ডের বিপক্ষে পরাজয়ের পরে দলের ব্যর্থতার দায়ভার তেন হাগ নিজের কাঁধে তুলে নেন। তিনি সেখানে আরো বলেন যে, তার দল সেই দুইটি ম্যাচ খুব একটা মনযোগ ও অধ্যবসায় দিয়ে খেলেনি। এই কথাগুলি ক্লাবটির সমর্থকদের ততদিনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, কেননা তেন হাগের আগে প্রচুর ম্যানেজার ক্লাবটিতে এসে একই রকম পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন, এবং প্রত্যেকেই এই একই কথাও বলেছেন। আর তখনই, তাদের জীবন আরো কঠিন করে দিতে আসে তাদের পরবর্তী প্রতিপক্ষ — লিভারপুল।

একজন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ভক্ত হিসেবে আপনি যদি সেদিন রাতে লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যাচটির পূর্বে খুবই ভীত একটি চিত্তে অবস্থান করে থাকেন, তাহলে আপনার লজ্জা পাবার কিছুই নেই। সকল ম্যান ইউ ভক্তের অবস্থাই সেদিন তেমনটি ছিল। তবে, সবাইকে তাক লাগিয়ে সেদিন নিজেদের মৌসুমের সেরা পারফর্মেন্সটি উপহার দেয় রেড ডেভিলরা, এবং চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে ম্যাচটি ২-১ গোলে জিতে নেয় তারা।

হঠাৎ করে এই পর্যায়ে এসে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর সবকিছুই যেন খাপে খাপ বসে যাচ্ছিল, এবং তাদের জন্য যেন আরো পথ খুলে যেতে শুরু করল। কিন্তু, এটিও স্পষ্ট ছিল যে, পথের একদম শুরুতেই তারা অবস্থান করছিল। মৌসুমের এখনো অনেকটাই বাঁকি, কিন্তু আপনি লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন যে, গত আগস্টে লীগ মৌসুম শুরুর সময়ের চেয়ে বর্তমানে এই ইউনাইটেড দলের আত্মবিশ্বাস অনেকাংশেই বেশি।

বর্তমানে তারা যে ফর্মে বা ধারায় অবস্থান করছে, বিগত বছরগুলিতে তারা সেটির ধারেকাছেও যেতে পারেনি। তবে, ঐতিহাসিকভাবেই ইউনাইটেড এমন একটি দল, যাদের উচিৎ লীগের যেকোন দলের বিপক্ষে ফেভারিট হিসেবেই মাঠে নামা। হয়তো বাস্তবে সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে আরো কিছুটা সময় তাদের দরকার হবে, তবে এই মৌসুমে যদি তাদের শীর্ষ চারে থাকতে হয়, তাহলে তুলনামূলক ছোট দলগুলির বিপক্ষে অন্তত তাদেরকে ফেভারিট তোকমাটা পুনরুদ্ধার করতেই হবে।

খেলোয়াড়দের থেকে সম্মান অর্জন (Earning the players’ respect)

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেওয়ার আগে থেকেই এরিক তেন হাগ তার অতি কঠোর কোচিং টেকনিক এর জন্য বিখ্যাত ছিলেন, এবং ইউনাইটেডে আসার পরও খুব জলদিই তিনি খেলোয়াড়দের সম্মান অর্জন করে নেন, এবং নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন।

মৌসুম শুরুর আগেই থাইল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ায় প্রাক মৌসুম প্রস্তুতিতেই তিনি তার কঠোরতার স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে ফেলেন। সেখানে পর পর দুইটি দলগত মিটিংয়ে দেরিতে আসার কারণে তিনি একজন যুবা খেলোয়াড়কে বহিস্কার করেন। সেই খেলোয়াড়ের অনিয়মের কারণে তাকে তিনি প্রাক মৌসুমের কোন ম্যাচেই খেলতে নামাননি।

শাস্তিপ্রাপ্ত সেই খেলোয়াড়টি হলেন আলেহান্দ্রো গার্নাচো, যিনি কি না বর্তমান মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রাক মৌসুম প্রস্তুতি তিনি গ্যালেরি থেকেই দেখেছিলেন। এরপর উয়েফা ইউরোপা লীগে রিয়াল সোসিয়াদাদ এর বিপক্ষে ম্যাচের পর তার পেশাদারিত্ব নিয়ে ব্রুনো ফার্নান্দেজ বলেছিলেন, “প্রাক মৌসুম সফরে তার যেমন ব্যবহার বা আচরণ থাকা উচিৎ ছিল, তেমনটি সে প্রদর্শন করতে পারেনি, এবং সেজন্যই সে এতদিন পর্যন্ত খেলার কোনই সুযোগ পায়নি। এখন সে খেলার সুযোগ পাচ্ছে, কারণ এখন সে তার প্রশিক্ষণে অনেক মনযোগী হয়েছে। এখন তার আচরণও আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে, এবং তাই দলে খেলার যোগ্যতাও সে অর্জন করেছে।”

ব্রেন্টফোর্ড এর বিপক্ষে ৪-০ গোলে হারার পর এরিক তেন হাগ তার খেলোয়াড়দেরকে শাস্তিস্বরূপ ১৩.৮ কিলোমিটার দৌড়িয়ে নিয়েছিলেন। ব্রেন্টফোর্ড এর বিপক্ষে ম্যাচটিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের থেকে ব্রেন্টফোর্ড ঠিক ১৩.৮ কিলোমিটারই বেশি দৌড়িয়েছিল।

ম্যাচটিতে হারের দায় এই ডাচ ম্যানেজার নিজের ঘাড়েই নিয়েছিলেন, এবং তিনি তার দলের থেকে যে কোন অংশেই উর্ধ্বে নন, সেটি প্রমাণ করার লক্ষ্যে তিনিও দলের অন্য সকলের সাথে সেই দৌড়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার এই কার্যক্রম দেখে দলের সকল খেলোয়াড়েরাই মুগ্ধ হয়েছিল, এবং তার প্রতি তাদের সম্মানও অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছিল।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো কেন্দ্রিক বিষয়ে তার বুদ্ধিদীপ্ততা এবং নীরব চৌকস্ব তাকে দলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের মধ্যে আরো প্রিয় করে তোলে। রোনাল্ডো বিষয়ক এসব ব্যাপার তাকে প্রাক মৌসুম থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছিল, কারণ ক্লাবের অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট অনুসারে, কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণেই সিআরসেভেন প্রি সিজনে অংশ নিতে পারেননি।

আর যখন তিনি ছুটি কাটিয়ে ফিরেছিলেন, তখন তার শারিরিক পরিস্থিতি (ফিটনেস) খুব একটা ভালো ছিল না, যার কারণে ম্যানেজার তাকে মূল একাদশে তেমন একটা সুযোগ দেননি। দলের রোটেশনে নিজের নতুন রোলটি নিয়ে রোনাল্ডো মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। প্রচন্ড আকারে বিতর্ক তৈরি হয়, যখন টটেনহ্যাম হটস্পার্স এর বিপক্ষে ২-০ গোলে জেতার দিনে তিনি বেঞ্চ থেকে মাঠে নামার আদেশ অমান্য করে ফুল টাইমের আগেই টানেল দিয়ে বের হয়ে যান। সেদিন অন্যান্য খেলোয়াড়েরা ড্রেসিং রুমে প্রবেশের পূর্বেই তিনি স্টেডিয়াম ছেড়ে বাড়ি চলে যান।

রোনাল্ডোকে এমন আচরণের জন্য শাস্তিও দেওয়া হতো। চেলসি’র বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচের স্কোয়াড থেকে তাকে বাদ রাখা হয়। পুরো স্কোয়াডের মধ্যে সাধারণ মন্তব্য এই ছিল যে, ম্যানেজার ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। পুরো বিষয়টি তিনি যেভাবে হ্যান্ডেল করছিলেন, তা দেখে দলের সকলেই খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন।

এর মাত্র কয়েকদিন পরেই পিয়ার্স মর্গানের অনুষ্ঠানে তার সমালোচিত সাক্ষাৎকারটি অনুষ্ঠিত হয়, এবং তার সাথে সাথেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে তার দীর্ঘকালীন সম্পর্কের অবসান ঘটে। এসবের ফলে অবশ্য এরিক তেন হাগের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।

সম্প্রতি টেনিংয়ে দেরিতে আসার কারণে এরিক তেন হাগ তার ইন-ফর্ম খেলোয়াড় মার্কাস র‍্যাশফোর্ডকে দলের বাইরে রেখেছিলেন।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর এই নতুন কোচ কোন প্রকার কয়েদি ধারণ করে রাখেন না।

মার্কাস র‍্যাশফোর্ড এর পুনর্জন্ম (The revival of Marcus Rashford)

এই ঠিক গত মৌসুমেই মার্কাস র‍্যাশফোর্ড এত বাজে ফর্ম পার করছিলেন, যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে, এবারের মৌসুমে ইউনাইটেডের নাম্বার টেন আবারো তার স্বভাবসুলভ ফর্মে ফিরেছেন, এবং অনেকের মতে, এটিই হল এ পর্যন্ত তার খেলোয়াড়ী জীবনের সবচেয়ে ভালো ফর্ম।

তিনি আর মাত্র একটি গোল/এসিস্ট অর্জন করতে পারলেই তার গত মৌসুমের গোল ইনভলভমেন্ট ট্যালিকে ছুঁয়ে ফেলতে পারবেন। এছাড়া, প্রিমিয়ার লীগে তার সবচেয়ে সেরা গোলস্কোরিং মৌসুমের গোল ট্যালিকে এবারের মৌসুমে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটি সুযোগও তার নিকট রয়েছে। এর পেছনে কিছুটা হলেও কৃতিত্ব দিতে হবে এরিক তেন হাগকে।

মৌসুমের ঠিক শুরু থেকেই এই ২৫ বছর বয়সী ইংলিশ তারকাকে নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তেন হাগ, এবং সেটির প্রতিদানও তিনি পেয়েছেন, মাঠে এবং মাঠের বাইরে। শুধু ক্লাব এর হয়ে নয়, বরং ইংল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপেও তিনি দলের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন। তেন হাগ তাকে বর্তমানে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন হিসেবে গণ্য করেন, এবং তাকে চিরদিন তার দলে চান বলেই জানা গিয়েছে। অবশ্য, তার বর্তমান ফর্মকে মাথায় রাখলে কেই বা তাকে দলে চাইবেন না?

এবারের এই মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড যাই অর্জন করুক না কেন, তার পেছনে অনেক বড় হাত থাকবে মার্কাস র‍্যাশফোর্ড এর।

গত মৌসুমে ইউনাইটেডের এতটাই অধঃপতন হয়েছিল যে, এবারের মৌসুমে তারা একটু ভালো করলেও সেটিকে অনেক বড় অর্জন মনে হচ্ছে। ধীরগতিতে হলেও ইউনাইটেড ঠিক পথেই এগুচ্ছে বলেই ধারণা করা যায়, এবং এরিক তেন হাগের মত একজন যোগ্য ব্যক্তি তাদের দায়িত্বে থাকায়, এমনটিও আশা করা যাচ্ছে যে, খুব শীঘ্রই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আবার নিয়মিত সাফল্যের মুখ দেখতে পারে।

Share.

Leave A Reply

Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.