যা যা থাকছে

  • ফলস নাইন এর উৎপত্তি: প্রকৃতপক্ষে “ফলস নাইন” বলতে কি বোঝায়?
  • আধুনিক ফুটবলে ফলস নাইন’কে জনপ্রিয় করে তুলেছেন কে?
  • আধুনিক সময়ের সেরা কয়েকজন ফলস নাইন
  • এমন কয়েকজন সেন্টার ফরোয়ার্ড যারা ফলস নাইন নন
  • প্রকৃত সেন্টার ফরোয়ার্ডরা কি দিন দিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছেন?
  • বিল্ড-আপ প্লে’তে কেন স্ট্রাইকারদেরকে আরো বেশি অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে?

সময়ের সাথে সাথে ফুটবলে অনেক ধরণের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। সকলের মতেই, এখন আমরা ফুটবলের আধুনিক যুগে অবস্থান করছি? কিন্তু এই যুগে কি আমরা কোন চড়াই উতরাই ছাড়াই পৌঁছে গিয়েছি? মোটেও না। বহু অসাধারণ খেলোয়াড় এবং অনবদ্য ম্যানেজারদের যুগান্তকারী সব অর্জন ও মুহূর্তের মধ্য দিয়ে আমরা আজকের এই মডার্ন গেইম’টি পেয়েছি। তারা যেসকল সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তা অবলোকন করার জন্যই যুগের পর যুগ দলে দলে মানুষ গ্যালেরিতে ভিড় করেছে, এবং এখনো করে চলেছে।

ফুটবল একটি সরল-সাদা খেলা, তবে অন্য যেকোন কিছুর মতই এতদিন ধরে মানুষের মনে জায়গা করে রাখার জন্য এই খেলাটিকেও অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কিভাবে ডিফেন্স থেকে শর্ট পাসিং এর মাধ্যমে বল সামনে অগ্রসর করতে হবে, খেলার গতি নিয়ন্ত্রণে একজন মিডফিল্ডারের ভূমিকা কি, এবং স্ট্রাইকাররা কেন মাঝমাঠে এসে বল সংগ্রহ করবেন — এসকল বিষয় ছাড়াও আরো অনেক জল্পনা কল্পনার কেবলমাত্র একটিই উদ্দেশ্য, এবং সেটি হল গোল করা।

গোলের কথা প্রসঙ্গে আরো একটি কথা না বললেই নয়, এবং সেটি হল এই যে, আমরা আজকে এমন একটি পজিশন নিয়ে আলোচনা লরব, যে পজিশনটিতে সম্ভবত গত এক যুগে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছে। ফুটবলের মাঠে সেই পজিশনটিকে বলা হয় “সেন্টার ফরোয়ার্ড” বা স্ট্রাইকার। আমরা এখন দেখব এই পরিবর্তনটি কখন এবং কেন হয়েছিল

ফুটবলে ফলস নাইন এর উৎপত্তি: প্রকৃতপক্ষে ফলস নাইন বলতে কি বোঝায়? (The rise of the false 9 in football  – What is the false 9 in football)

ফুটবল খেলায় ফলস নাইন তাকেই বলা হয় যিনি একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড না হয়েও সেই পজিশনটিতে খেলে থাকেন, এবং তার ফরোয়ার্ড পজিশন থেকে নিচে নেমে এসে খেলায় অংশগ্রহণ করেন। এই ধরণের খেলোয়াড়কে ফলস নাইন ডাকার পেছনে মূল কারণ হল এই যে, তারা ফুটবল মাঠে এমন এমন পজিশন নিতে পারেন, যা একজন স্বভাবসুলভ সেন্টার ফরোয়ার্ডকে নিতে দেখা যায় না।

যখন তারা ফরোয়ার্ড পজিশন থেকে নিচে নেমে আসেন, তখন তারা মাঝমাঠে এক ধরণের ওভারলোড তৈরি করার চেষ্টা করেন, যাতে করে মিডফিল্ডে একজন অতিরিক্ত খেলোয়াড় যুক্ত হয়, এবং একটি অতিরিক্ত পাসিং অপশন তৈরি হয়। এতে করে তার দল একটি গোছানো ডিফেন্সকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।

তাদের পজিশন ছেড়ে নিচে নেমে আসার আরেকটি কারণ হল সাথে করে প্রতিপক্ষের একজন ডিফেন্ডারকেও টেনে আনা। যখন একজন ফলস নাইন খেলোয়াড় তার সেন্টার ফরোয়ার্ড এর পজিশন ছেড়ে নেমে যান, তখন খুব কম সময়ের মধ্যে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেহেতু ফলস নাইন মিডফিল্ডে নেমে যাওয়ায় প্রতিপক্ষের মিডফিল্ড খেলোয়াড়েরা আউটনাম্বারড হয়ে যান, সেক্ষেত্রে ঐ ডিফেন্ডারের মাথায় তখন চলতে থাকে যে, তার কি ফলস নাইন এর সাথে মিডফিল্ডে যাওয়া উচিৎ নাকি নিজের পজিশনে অটল থেকে খেলা তার কাছে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিৎ?

সেই ডিফেন্ডার যদি ফলস নাইনকে মিডফিল্ডে অনুসরণ না করেন, তাহলে ফলস নাইন মিডফিল্ডে গিয়ে দুই লাইনের মাঝখানে বল রিসিভ করতে পারেন, এবং গোলের দিকে ঘুরতে পারেন, যার ফলে সেই ডিফেন্ডার ব্যাক ফুটে পড়ে যেতে পারেন।

আবার, যদি সেই ডিফেন্ডার নিজের পজিশন ছেড়ে ফলস নাইনকে অনুসরণ করেন, তাহলে তিনি নিজের ছেড়ে যাওয়া পজিশনে স্পেস ফেলে যাচ্ছেন, যেখানে প্রতিপক্ষের অন্য কোন খেলোয়াড় জায়গা নিতে পারেন, এবং বল সংগ্রহ করে গোল দিতে পারেন।

ফুটবলে ফলস নাইন আসলে কি? – কিভাবে তা একটি ফর্মেশনকে প্রভাবিত করে? (What is a false 9 in football – how does it affect formations?)

ফলস নাইন সম্পন্ন একটি ফর্মেশনে যখন ফলস নাইন হিসেবে খেলা খেলোয়াড় মিডফিল্ডে নেমে যান, তখন প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে একরকম অরাজকতা সৃষ্টি হয়, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই ডিফেন্সে শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয়, যেখানে ফলস নাইনের দলের কোন মিডফিল্ডার বা উইংগার জায়গা করে নেন। বিশেষ করে, ওয়াইড খেলোয়াড়েরা অর্থাৎ উইংগাররা সেই শূন্যস্থানের পূর্ণ ফায়দা উঠানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকেন।

ফলস নাইন ফর্মেশনটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমন সব দলগুলিই ব্যবহার কর থাকে, যারা বল পজিশন রেখে খেলতে পছন্দ করে। পজিশন নির্ভর বেশির ভাগ দলই ডিফেন্স থেকে বিল্ড-আপ প্লে শুরু করে, এবং মিডফিল্ড হয়ে আক্রমণে গিয়ে থাকে। এই কারণে, ফলস নাইন যথেষ্ট সময় পান মিডফিল্ডে নেমে আসার, বল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার, এবং গোলের সুযোগ তৈরি করার।

আধুনিক ফুটবলে কে বা কারা ফলস নাইন’কে জনপ্রিয় করে তুলেছেন? (Who made the false 9 famous in modern football)

যে খেলোয়াড়টি এই ফলস নাইন পজিশনে সবচেয়ে ভালো খেলতেন, তিনি হলেন লিওনেল মেসি (যখন তিনি বার্সেলোনাতে খেলতেন)। অর্থাৎ, এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই যে, কে এই পজিশনের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। ২০০৯ সালের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালের দিন তৎকালীন বার্সেলোনা কোচ পেপ গার্দিওলা হঠাৎ করেই একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সাধারণত রাইট উইঙে খেলা মেসিকে তিনি সেদিন ফলস নাইন হিসেবে মাঠে নামিয়েছিলেন, এবং সে সময়কার সেরা সেন্টার ফরোয়ার্ডদের একজন স্যামুয়েল ইতো’কে সেদিন তিনি খেলিয়েছিলেন রাইট উইঙে।

পড়ুন:  কিভাবে আর্সেন ওয়েঙ্গার আর্সেনাল ফুটবল ক্লাবে বিপ্লব ঘটিয়েছে (1996-2018)

এই ট্যাকটিকাল পরিবর্তনের কারণে মেসি বার্সার মিডফিল্ডে জাভি এবং ইনিয়েস্তার সঙে যুগলবন্দী করে খেলতে পেরেছিলেন, এবং সেটির সুফলও ছিল বেশ সুস্পষ্ট। সেদিন তারা স্যার আলেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দলকে বেশ সহজেই ২-০ গোলে হারিয়ে ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেই দিনের পর থেকেই ফুটবলের খাতায় ফলস নাইন এর নামটি উঠে আসতে শুরু করে।

পেপ গার্দিওলা’র যুগান্তকারী সেই বার্সেলোনা দলটির মূল চালিকাশক্তিই ছিলেন লিওনেল মেসি, ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড, যিনি কাগজে কলমে কোন দিক দিয়েই সে সময়কার বা তারও আগের অন্যান্য নামকরা স্ট্রাইকারদের সমকক্ষ ছিলেন না।

লিওনেল মেসি’র বুদ্ধিদীপ্ততার পাশাপাশি জাভি, ইনিয়েস্তা, এবং সার্জিও বুস্কেটস এর মত খেলোয়াড়দের অসীম দক্ষতার উপর ভর করেই একটি অপ্রতিরোধ্য বার্সা দল তৈরি করতে পেরেছিলেন গার্দিওলা। ফলস নাইন ফর্মেশনে খেলে তারা দুইটি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপাসহ আরো অনেক ধরণের শিরোপা জয় করেছিল। ফুটবলের বিবর্তনে সেটি ছিল একটি নতুন ধাপ।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এখানে একটি তথ্য জানিয়ে দেওয়া দরকার, এবং সেটি হল এই যে, ফলস নাইন পজিশনটিকে লিওনেল মেসি জনপ্রিয় করে তুললেও, তিনি অন্য পজিশন থেকে সেন্টার ফরোয়ার্ডে রূপান্তরিত প্রথম খেলোয়াড় ছিলেন না। ১৮৯০ এর দশকে ব্রাজিলিয়ান লীগের ক্লাব করিন্থিয়ান্সে একজন খেলোয়াড় ছিলেন, যার নাম ছিল জিও স্মিথ, যিনি একবার মিডফিল্ড থেকে সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে শিফট করেছিলেন। তাই, বলা যায় যে, তিনিই ছিলেন বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে প্রথম ফলস নাইন।

জিও স্মিথ নিজেও একজন প্রকৃত সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিলেন না। তিনি বেশি পছন্দ করতেন একজন প্লেমেকার হিসেবে সেন্টার ফরোয়ার্ড এর পেছনে খেলতে। তার সেই পজিশনটি পছন্দ করার পেছনে একটিই কারণ ছিল, এবং সেটি হল এই যে, তিনি ভাবতেন ঐ পজিশনে থেকে তিনি খুব সহজেই তার সতীর্থদেরকে ডিফেন্স চেড়া থ্রু বল প্রদান করতে পারবেন। তাকে সবাই জানতো “কনডাক্টর” নামে। এছাড়াও, ফুটবলের প্রাচীন ইতিহাসে বেশ কয়েকবার এই ফলস নাইন এর কনসেপ্টটি গ্রহণ করা হয়েছে বলেই ধারণা করা যায়, কিন্তু কখনো সেটিকে বড় কোন অর্জনে কেউই রূপান্তরিত করতে পারেনি।

আধুনিক সময়ের কয়েকজন জনপ্রিয় ফলস নাইন খেলোয়াড় (Modern False 9s)

সেস্ক ফ্যাব্রেগাস – বার্সেলোনা এবং স্পেন (Cesc Fabregas – Barcelona & Spain)

সাবেক এই স্প্যানিশ তারকা মিডফিল্ডার টাটা মার্তিনো’র অধীনে বার্সেলোনাতে এই রোলে খেলেছিলেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন যখন তিনি ইউরো ২০১২ তে ভিসেন্তে দেল বস্ক এর অধীনে স্পেন জাতীয় দলের হয়ে ফলস নাইন হিসেবে খেলেছিলেন। সেবার শিরোপাটিও জিতেছিল স্পেন।

সেস্ক ফ্যাব্রেগাস, যিনি কি না স্বভাবত একজন মিডফিল্ডার, সেই রোলটিতে খুব সহজেই মানিয়ে নিয়েছিলেন, এবং সর্বদা মিডফিল্ডে ওভারলোড তৈরি করে তার পেছনের খেলোয়াড়ের নিকট পাস দিতে পেরেছিলেন।

এমনকি, যখন প্রতিপক্ষ তার দেওয়া পাসগুলি রুখেও দিতো, তখনও তার সতীর্থরা যেমন জাভি, ইনিয়েস্তা এবং বুস্কেটস’রা স্পেস খুঁজে নিয়ে সেসব পাস সম্পন্ন করতেন। অথবা, পাসের রাস্তা খোলা না থাকলে তারা অন্য রাস্তা দেখতেন, কিন্তু পথ একটা না হোক একটা খুঁজে বের করতেনই। মাঠের মাঝের অংশে স্পেনের এই শক্তিমত্তার সাথে পেরেই উঠতো না বেশির ভাগ দল।

সেই টুর্নামেন্টে মূলত বেঞ্চ থেকে নেমে তিনটি গোল করেছিলেন স্পেনের তুলনামূলকভাবে ট্র‍্যাডিশনাল স্ট্রাইকার ফার্নান্দো তোরেস। কিন্তু, পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই জায়গাটি নিজের করে রেখেছিলেন সেস্ক ফ্যাব্রেগাস।

ফিল ফোডেন – ম্যানচেস্টার সিটি (Phil Foden – Manchester City)

এই স্বল্প বয়সেই ফিল ফোডেনকে বেশ কিছু পজিশনে খেলিয়ে দেখেছেন পেপ গার্দিওলা, এবং সবগুলো পজিশনেই নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন এই ইংলিশ মিডফিল্ডার/উইংগার। সার্জিও আগুয়েরো ক্লাব ছাড়ার পর (এমনকি তার ইঞ্জুরিবহুল শেষ মৌসুমেও) ফিল ফোডেনকে ফলস নাইন হিসেবে খেলিয়েই প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা জিতেছেন পেপ গার্দিওলা। আর্লিং হাল্যান্ড দলে আসার আগ পর্যন্ত ফিল ফোডেনই ছিলেন দলের মূল স্ট্রাইকার।

তার টেকনিক্যাল দক্ষতার কারণে তিনি খুব সহজেই প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ও মিডফিল্ড লাইনের মাঝামাঝি জায়গা করে নিতে পারতেন, এবং নিজে বল রিসিভ করে দলের অন্যান্যদের জন্য স্পেস খালি করে দিতেন। তার অসাধারণ ড্রিবলিং স্কিলের দরুণ এই ইংলিশ মিডফিল্ডার খুবই ভালো ক্লোজ-কন্ট্রোল করতে পারেন এবং বলের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন। এছাড়া, তার বুদ্ধিমত্তা ও চাতুরতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সময়মত বল রিলিজও করতে পারেন।

কারিম বেঞ্জেমা – রিয়াল মাদ্রিদ (Karim Benzema – Real Madrid)

বর্তমান ব্যালন ডি’অর পুরষ্কারজয়ী কারিম বেঞ্জেমা হলেন এমন একজন স্ট্রাইকার যাকে কালের বিবর্তনে একজন ফলস নাইন হিসেবেও খেলতে হয়েছে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এবং অনেক সময় গ্যারেথ বেলকে গোল করার সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্যে অনেক সময় তাকে ড্রপ-ডাউন করতে হত মিডফিল্ডে, যাতে করে তার ফেলে আসা স্পেসে অপর দুইজনের অন্তত একজন ঢুকে পড়তে পারেন।

পড়ুন:  ম্যাচডে 2 পুরস্কার

তখন বেঞ্জেমাই ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের মিডফিল্ড এবং অ্যাটাকের মধ্যকার যোগসূত্র। তার বিসর্জনের কারণেই তার দুই ফরোয়ার্ড পার্টনারের নিকট তার থেকে বেশি গোল থাকতো। তাদের তিনজনের মধ্যকার এই দূর্দান্ত যুগলবন্দীর কারণেই সেই ট্রায়োকে ডাকা হত “বিবিসি” (বেল-বেঞ্জেমা-ক্রিশ্চিয়ানো)।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এবং গ্যারেথ বেল দল ছাড়ার পর এখন কারিম বেঞ্জেমার খেলায় আরো অনেক দিক যুক্ত হয়েছে। তিনি এখন একজন ট্র‍্যাডিশনাল সেন্টার ফরোয়ার্ড এবং একজন ফলস নাইন এর মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করছেন। শুধুমাত্র গত মৌসুমেই তিনি সর্বমোট ৪৪টি গোল এবং ১৪টি এসিস্ট করতে সক্ষম হোন। তিনি এ সবকিছু করেন একজন ফিজিক্যাল সেন্টার ফরোয়ার্ড এর দেহ নিয়ে।

হ্যারি কেইন – টটেনহ্যাম হটস্পার্স এবং ইংল্যান্ড (Harry Kane – Tottenham Hotspurs & England)

ইনি হলেন আরেকজন স্ট্রাইকার যাকে কারিম বেঞ্জেমার সাথেই তুলনা করা যায়। তার নিকট এমন সকল এট্রিবিউট এবং শারিরিক গঠন রয়েছে, যা তাকে একজন ওল্ড-ফ্যাশনড সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে দেখতে বাধ্য করে, যিনি প্রচুর গোল করতে পারদর্শী। কিন্তু, তার নিকট মিডফিল্ডে গিয়ে বল রিসিভ করার সুবুদ্ধিও রয়েছে, যাতে করে তিনি খেলার মোড় ঘুরাতে পারেন, এবং অন্যান্য টিমমেটদেরকে দিয়ে গোলও করাতে পারেন।

যেমনটি আমি আগেও বলেছি, ফলস নাইন’দেরকে মূলত এমন দলেই খেলানো হয়, যেসব দল সাধারণত পজিশন ফুটবল খেলে থাকে। তবে, কেইন সেই রোলটিতে খেলেছে একটি কাউন্টার অ্যাটাকিং দলের অংশ হয়ে। প্রথমে হোসে মোরিনহোর অধীনে, এবং এখন আন্তোনিও কন্তে’র অধীনে তিনি নিচে নেমে গিয়ে বল রিসিভ করতে পারদর্শী হয়ে উঠেছেন, এবং খেলায় ট্রাঞ্জিশন ঘটাতে হয়ে উঠেছেন পটু। তিনি তার পেছনের শূন্যস্থানে সন হিউং মিন বা ডেয়ান কুলুসেভস্কিকেও খুব সহজেই খুঁজে নিতে পারেন।

এমন কয়েকজন আধুনিক সেন্টার ফরোয়ার্ড যারা ফলস নাইন নন (Who are modern forwards that are not false 9s?)

আর্লিং হাল্যান্ড – ম্যানচেস্টার সিটি (Erling Haaland – Manchester City)

নরওয়েজিয়ান এই স্ট্রাইকার সম্প্রতি প্রিমিয়ার লীগে এসে লীগটিতে ঝড় তুলেছেন। ম্যান সিটি’র হয়ে মাত্র ২১টি ম্যাচ খেলে তিনি ইতিমধ্যে মোট ২৬টি প্রিমিয়ার লীগ গোল করে ফেলেছেন। এই যাত্রায় তিনি প্রিমিয়ার লীগের বেশ কিছু গোলস্কোরিং রেকর্ডও ভেঙে ফেলেছেন। মৌসুম শেষ হওয়ার আগে তিনি আরো অনেক রেকর্ড ভাঙবেন, এটিও প্রায় অবধারিত। তবে, পূর্বে আলোচিত ফলস নাইন ফিল ফোডেনের থেকে তিনি অনেকাংশেই আলাদা একজন ফরোয়ার্ড।

যদিও তিনি অহরহ পাসে পা বা মাথা ঠেকিয়ে গোল করেছেন, তবুও দলের বিল্ড-আপ প্লে’তে অংশগ্রহণ করতে কিছুটা বেগ পেয়েছেন এই স্ট্রাইকার, যা তার কোচ পেপ গার্দিওলাকে মোটেও খুশি করেনি।

বিল্ড-আপ প্লে’তে অংশগ্রহণ করাতে তার অপারগতার কারণে তাকে তার সতীর্থদের ডেলিভারির উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে থাকতে হয়, যা প্রতিপক্ষ অনেক সময় বন্ধ করে দিতে সমর্থ হয়। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে তাদের সাম্প্রতিক পরাজয়টি হল এই বিষয়টির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

পিয়ের এমেরিক অবামেয়াং – চেলসি (Pierre Emerick Aubameyang – Chelsea)

পিয়ের এমেরিক অবামেয়াং হয়তো তার ক্যারিয়ারের অন্তিম লগ্নে অবস্থা করছেন ঠিকই, তবে তার ক্যারিয়ারের প্রাইম সময়ে তিনি সবসময়ই অফেন্সিভ লাইনের সর্বোচ্চ পর্যায়েই খেলতেন। তার মূল শক্তির জায়গাই ছিল তার দূর্দান্ত গতিকে কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের পেছনে দৌড় দেওয়া, এবং থ্রু বল সংগ্রহ করে গোল করা।

বর্তমানে চেলসিতে কাই হ্যাভার্টজ হলেন কোচ পটারের অধিক পছন্দের অপশন, কেননা তিনি মিডফিল্ডে নেমে বল রিসিভ করতে প্রস্তত, যা অবামেয়াং করেন না বললেই চলে। হ্যাভার্টজ এর নিকট একজন অসাধারণ ফলস নাইন হওয়ার জন্য সব ধরণের দক্ষতাই রয়েছে। তবে, দু:খজনক হলেও সত্যি হল এই যে, অবামেয়াং এসকল দিক দিয়ে একদমই পারদর্শী নন, যার কারণে তিনি ক্রমেই পটারের ভালোর তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছেন।

ভিক্টর ওসিমহেন – নাপোলি (Victor Osimhen – Napoli)

সিরি আ লীগ লিডার্স নাপোলির স্ট্রাইকার ভিক্টর ওসিমহেন হলেন বর্তমানে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে প্রাইজড এসেটদের মধ্যে একজন। তিনি বর্তমান মৌসুমে সিরি আ’র সর্বোচ্চ গোলদাতাও বটে। তার এই সাফল্যের পেছনে মূল কারণই হল তার অদম্য গতি, শারিরিক শক্তি, এবং বক্সের মধ্যে নিজের জন্য স্পেস তৈরি করে নেওয়ার এক অসাধারণ ক্ষমতা, যা দিনের পর দিন আরো ভালোই হয়ে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে।

তিনি এখনো উন্নয়নের প্রক্রিয়াতেই রয়েছেন, তবে এখন পর্যন্ত এই অত্যন্ত প্রতিভাবান নাপোলি স্ট্রাইকার ফলস নাইন হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি। তার খেলায় এই নতুন সংযোজনটি না আনলে হয়তো তিনি ভবিষ্যতে আকাশচুম্বী সফলতা অর্জন করতে ব্যর্থ হবেন।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো – আল নাসর (Cristiano Ronaldo – Al Nasser)

কিংবদন্তি এই পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড এখন সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসের এ খেলছেন, কিন্তু গত ১৮ মাস যাবত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে তিনি যেভাবে খেলেছেন, সেটি ছিল একরকম উদাহরণস্বরূপ যে কিভাবে একজন ফলস নাইন না হওয়া যায়।

পড়ুন:  ম্যাচউইক পুরস্কার

রেড ডেভিলদের হয়ে নিজের সেকেন্ড ইনিংস খেলতে নেমে তিনি সেন্টার ফরোয়ার্ড এর পজিশন থেকে মোট ২৫টিরও বেশি গোল স্কোর করেন। তার গোল ট্যালি হয়তো বেশ সমৃদ্ধ ছিল, তবে তার মোটমাট পারফর্মেন্স মোটেও মনপ্রুত ছিল না।

রোনাল্ডো পুরো ২০২১-২২ মৌসুম জুড়েই যথেষ্ট সজাগ ছিলেন না, এবং সময়মত তিনি মিডফিল্ডে নেমে দলকে সহায়তাও করতেন না। সেটি না করে তিনি অযথাই বলের খোঁজে ওয়াইড পজিশনে চলে যেতেন, এবং বল পাওয়ার পরে কি করবেন তা আর বুঝতেন না। এর ফলে বেশির ভাগ সময়েই রেড ডেভিলদের আক্রমণ ভেস্তে যেতো, এবং দলের গঠন পুরোপুরিভাবে বিগড়ে যেতো।

প্রকৃত সেন্টার ফরোয়ার্ডরা কি দিন দিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছেন? (Are Proper Center forwards becoming extinct?)

এটি আসলেই সত্য যে, ট্র‍্যাডিশনাল গোল পোচার্স যেমন ফিলিপ্পো ইনজাঘি, মাইকেল ওয়েন, রুড ভ্যান নিস্টেলরয়, রবিন ভ্যান পার্সি এবং সাম্প্রতিক সময়ে জেমি ভার্ডি বা রোমেলু লুকাকু’দের সময় এখন শেষের দিকেই পৌঁছে গিয়েছে। তবে, এমনটি মোটেই সত্য নয় যে, স্ট্রাইকার পজিশনটিই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। বরং, এমনটিই বলা সমীচীন হবে যে, নিশ্চিহ্ন নয়, বিবর্তনের পথে রয়েছে পজিশনটি।

ফুটবলের এই আধুনিক যুগে এসে একজন স্ট্রাইকারের সক্ষমতা পরিমাপ করা হবে খেলায় তার মোটমাট অংশগ্রহণের উপর, শুধুমাত্র তার গোল ট্যালির উপর নয়। এছাড়া, স্ট্রাইকারটি প্রতিপক্ষের দুই লাইনের মাঝে নেমে এসে কতটা ভালোভাবে বিল্ড-আপ প্লে’তে অংশ নিতে পারছে সেটির দ্বারা, বা তার টেকনিক্যাল দক্ষতা (ড্রিবলিং, পাসিং) দিয়ে তার সতীর্থদের কতটা সাহায্য করতে পারছেন, সেটির উপর ভিত্তি করে তাকে বিচার করা হবে।

শীর্ষ পর্যায়ের একজন স্ট্রাইকার হতে হলে এখন যেসব স্কিল প্রয়োজন তা পূর্বের থেকে অনেকটাই আলাদা। যুবা পর্যায় থেকেই এসকল নতুন স্কিল স্ট্রাইকারদের শেখানো হচ্ছে। যুবা একাডেমিগুলোর এখন কাজই হল আধুনিক ছাঁচে ট্র‍্যাডিশনাল স্ট্রাইকার তৈরি করা, এবং একজন শীর্ষ পর্যায়ের স্ট্রাইকার হতে হলে যেসব দক্ষতা দরকার সেগুলো শেখানো।

বিল্ড-আপ প্লে’তে কেন স্ট্রাইকারদেরকে আরো বেশি অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে? (Why do strikers have to be more present in buildup?)

গোলের অল্টার্নেটিভ উৎস (Alternative goal threats)

থিয়েরি অঁরি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, এবং মোহাম্মদ সালাহ্ এর মত খেলোয়াড়দের জাগরণের সাথে সাথে এই ধারণাটির অবসান ঘটেছে যে শুধুমাত্র সেন্টার ফরোয়ার্ডদের উপরেই গোল করার দায়িত্ব বর্তায়, কারণ তারা উইংগার হয়েও প্রচুর গোল স্কোর করে থাকেন।

এমন গোলস্কোরিং উইংগারদের সংখ্যা আধুনিক ফুটবলে ক্রমে বেড়েই চলেছে, এবং তারই সাথে কমছে স্ট্রাইকারদের উদ্দেশ্যে সার্ভিস। এতে করে স্ট্রাইকাররা এখন বাধ্য হচ্ছেন প্রতিপক্ষের ডি বক্সে সুযোগের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে না থেকে নিজেদের খেলায় নতুন অনেক দিক যুক্ত করতে। ফলে, তারা নিজেরা নিজেদের জন্য আরো বেশি সুযোগ তৈরি করে নিতে পারছেন, এবং বিল্ড-আপ প্লে’তে আরো বেশি অংশগ্রহণ করে দলকে নানাভাবে সাহায্য করতে পারছেন।

দৃঢ় ডিফেন্স (Compact defence)

দৃঢ় ডিফেন্সিভ কাঠামো হল এমন একটি বিষয় যেটির দিকে আধুনিক ফুটবলে দিন দিন আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যেসকল দল সাধারণত পজিশন ফুটবল খেলায় পারদর্শী হয়ে থাকে, সেসকল দলের বিপক্ষে খেলার সময় বেশির ভাগ দলই নিজেদের ডিফেন্সিভ লাইনকে পেছনে সরিয়ে আনে, এবং মিডফিল্ড ও ডিফেন্সিভ লাইনের মধ্যেও দূরত্ব কমিয়ে আনে। ফলে, তাদের ডিফেন্স আরো কম্প্যাক্ট হয়ে ওঠে, এবং লাইন ব্রেক করে পাসিং করা প্রতিপক্ষের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।

এধরণের কম্প্যাক্ট ডিফেন্সের বিপক্ষে গোল করার বিকল্প উপায়ও অবশ্য এখনকার পজিশন বেজড দলগুলি বের করে রেখেছে। এখানে বলাই বাহুল্য যে, এসকল পদ্ধতির মধ্যেই অন্যতম হল ফলস নাইন ফর্মেশন।

একজন স্বাভাবিক স্ট্রাইকার যিনি সার্ভিসের জন্য ডি বক্সের মধ্যে অপেক্ষা করে থাকেন, তাকে খেলার অনেক বড় বড় অংশ জুড়ে খুঁজেই না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কারণ সেক্ষেত্রে তার দল মূলত বিল্ড-আপ প্লে’তে ১০ জন এর বিপক্ষে ৯ জন নিয়ে খেলছে। যখন স্ট্রাইকারটি কেবলমাত্র তখনই বিল্ড-আপ প্লে’তে অংশগ্রহণ করেন যখন তার ইচ্ছা হয়, তখন তাকে মার্ক করা প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডার বা মিডফিল্ডারদের জন্য সহজ হয়, কারণ তাকে নিমিশেই ঘিরে ধরতে পারেন তারা।

অন্যদিকে, যখন একজন স্ট্রাইকার ফলস নাইন বা আরো গভীরের কোন রোলে খেলবেন, তখন তিনি প্রতিনিয়তই একজন ডিফেন্ডারকে নিজের পেছনে ঘুরাতে পারবেন, এবং চাইলে মাঝ মাঠে মিডফিল্ড ওভারলোডও তৈরি করতে পারবেন। প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ও মিডফিল্ড লাইনের মঝের অংশে বল রিসিভ করে তিনি তার সতীর্থদের জন্য স্পেসও তৈরি করতে পারবেন, যাতে করে আরো বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।

যখন একজন ফলস নাইন প্রতিপক্ষের ডিফেন্সিভ গঠনকে তচনচ করতে পারেন, তখন তার দলের জন্য সেই কম্প্যাক্ট ডিফেন্সকে ভেঙে গোলের সুযোগ তৈরি করা আরো সহজ হয়। এজন্যই মূলত আধুনিক ফুটবলে এধরণের পজিশন অনেক বেশি গুরুত্ব বহণ করে।

Share.
Leave A Reply