যেহেতু কাতারে অনুষ্ঠিতব্য ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ শুরু হতে এখন আর এক মাসেরও কম সময় বাকি, সেহেতু বিশ্বব্যাপী ক্লাব ফুটবল থেকে সবার মনযোগ এখন আন্তর্জাতিক ফুটবলের দিকে ধাবিত হতে শুরু করেছে, কারণ বিশ্বকাপের কারণে ৬ সপ্তাহ ক্লাব ফুটবল স্থগিত থাকবে, এবং পুরো বিশ্বের নজর থাকবে কাতারে।

২০ বছর আগে ২০০২ সালে কোরিয়া/জাপানে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এবার দ্বিতীয়বারের মত এশিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাই, এবারের কাতার বিশ্বকাপ আগের যেকোন বিশ্বকাপ থেকে আলাদা হতে চলেছে, এবং এই আসরের বৈচিত্র্যময়তাই অনেক ডার্ক হর্স’দেরকে সুযোগ করে দিতে পারে অভাবনীয় কিছু অর্জন করার।

প্রথমবারের মত শীতকালীন ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির বিচিত্র আবহাওয়া সকল খেলোয়াড় ও দলের জন্যই নতুন হবে, এবং সেটি তাদের সামনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জও ছুঁড়তে থাকবে। 

যদিও র‍্যাংকিং ও ফর্মের ভিত্তিতে এটি বলাই যায় যে, ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ জেতার জন্য সবচেয়ে ফেভারিট দল হল ব্রাজিল। তবে তাদের পাশাপাশি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং আর্জেন্টিনাও বেশ ভালো দল গঠন করতে পেরেছে বিশ্বকাপটির আগে। তারাই এবারের শিরোপা জয়ের জন্য শীর্ষ দাবিদার।

তবে, এসকল ফেভারিট দলকে দূরে রেখে আমরা আজ এই নিবন্ধটিতে এক নজর তাকাব সেসকল দলের দিকে, যারা কি না আন্ডারডগ হিসেবেই টুর্নামেন্টেটিতে প্রবেশ করবে, কিন্তু সকলকে বিষ্মিত করে দিয়ে বড় কিছু অর্জন করে নেওয়ারও সামর্থ্য রাখে।

কাতার (Qatar)

আজ থেকে ঠিক ১২ বছর আগে ফিফা ঘোষণা করে যে ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপটি অনুষ্ঠিত হবে কাতারে। তারপর থেকেই সেটি নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা, আলোচনা ও সমালোচনা চলতে থাকে। তবে, এই সময়কালের মধ্যে কাতার তাদের নিজেদের ফুটবলীয় দূর্বলতাগুলি ঝালাই করে নিতে থাকে, এবং ফিফা র‍্যাংকিং এ মোট ৬৫ স্থান উপরে উঠে আসে। এ যাত্রায় তারা ২০১৯ সালের এএফসি এশিয়া কাপ এর শিরোপা জিতে নেয়, ২০২১ সালের কনকাকাফ গোল্ড কাপের সেমি ফাইনালে অবতরণ করে, এবং ঘরের মাটিতে ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ফিফা আরব কাপে ৩য় স্থানও অধিকার করে। 

পড়ুন:  পেলে'র প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ ফুটবলের চেহারা বদলে দেওয়া এক ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির কাহিণী

তাদের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ফিফা বিশ্বকাপে খেলতে নামতে যাচ্ছে কাতার। এ যাত্রায় তাদের দায়িত্বে রয়েছেন স্প্যানিশ কোচ ফেলিক্স স্যঞ্চেজ, যিনি কি না এর আগে বার্সেলোনার যুবা দলের কোচ ছিলেন এবং একটি আকর্ষণীয় ফুটবলীয় দর্শন নিজের মধ্যে পুষে থাকেন।

বিশ্বকাপের আগে কাতার প্রচুর আন-অফিসিয়াল ফ্রেন্ডলি খেলায় অংশ নেওয়ায় তারা অন্যান্য সকল দলের চেয়েই প্রস্তুতি ও টিম স্পিরিট এর দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে। বলাই বাহুল্য, অন্যান্য সেসকল দলই বছর অন্তে হাতে গোনা কিছু আন্তর্জাতিক খেলাই খেলে থাকে।

২০১৮ সালে রাশিয়া, এবং তার আগে ২০২২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া প্রমাণ করেছে যে, বিশ্বকাপের স্বদেশী দলকে কখনোই ছোট করে দেখা সমীচীন নয়। তারা যেকোন ম্যাচেই অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারে।

ডেনমার্ক (Denmark)

২০২০ সালে অনুষ্ঠিত উয়েফা ইউরোতে গ্রেট ডেনস খ্যাত ডেনমার্ক দলটি দূর্ঘটনার একদম দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল যখন তাদের অধিনায়ক ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন কার্ডিয়াক এরেস্ট এর কারণে খেলা চলাকালীনই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। তবে, সেই দূর্ঘটনাটি তাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, বরং তাদের মধ্যে আরও বেশি শক্তির সঞ্চার করে, এবং তাদের দূর্দান্ত ঐক্যবদ্ধতার ফলস্বরূপ তারা টুর্নামেন্টটির সেমি ফাইনাল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। 

বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার যাত্রায় ডেনমার্ক তাদের কোয়ালিফাইং গ্রুপে ১০টি ম্যাচের মধ্যে ৯টিতেই জয়লাভ করে, যার মধ্যে তারা মোট ৩০টি গোল স্কোর করে, এবং বিনিময়ে হজম করে মাত্র ৩টি গোল। এছাড়া, তাদের প্রভাবশালী সেই প্লেমেকার এরিকসেনও আবার পূর্ণ ফর্মে মাঠে ফিরেছেন।

যেকোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট এর জন্যই খুবই পারদর্শী একটি দল তৈরি করেছেন ড্যানিশ কোচ ক্যাস্পার জুলমান্ড। বর্তমান ফিফা র‍্যাংকিংয়ে তারা ১০ম স্থানে অবস্থান করছে, বিধায় প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস নিয়েই তারা এবারের বিশ্বকাপে প্রবেশ করতে চলেছে। 

ড্যানিশ ডাইনামাইট খ্যাত ডেনমার্ক জাতীয় দলটি ইউরোপের সব দলকে বাজিমাত করে ১৯৯২ সালের উয়েফা ইউরো শিরোপাটি ঘরে তুলেছিল। এরপর ২০২০ সালের উয়েফা ইউরোতেও তারা তাদের সামর্থ্যের জানান দিয়েছে। ১৯৯৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে তারা কোয়ার্টার ফাইনাল স্টেজ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিল। এবার তাদের ৬ষ্ঠ বিশ্বকাপ আসরে তারা তার চেয়েও ভালো ও বড় কিছু অর্জন করতে চাইবে, সে ব্যাপারে কোনই দ্বিধা নেই।

পড়ুন:  মিড-সিজন রিপোর্ট এবং ডেডলাইন ডে'র দিকে ফিরে তাকানো

যুক্তরাষ্ট্র (United States of America)

যদিও খুব বেশি সংখ্যক ফুটবল বিশ্লেষক বা বোদ্ধারা যুক্তরাষ্ট্রকে এবারের বিশ্বকাপে ডার্ক হর্স হিসেবে দেখতে নারাজ, তবুও দেশটির নিকট বর্তমানে কিছু জেনারেশনাল প্রতিভা রয়েছে, যারা কি না ২০২২ সালে এসে একসাথে ফুটে উঠতেও পারে।

২০১০ ও ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে টানা দুইবার রাউন্ড অব ১৬ তে খেলার পর ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে তারা তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। কাতার বিশ্বকাপ ২০২২ এ অবশ্য তাদের নিকট ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচ, ব্রেন্ডেন এরোনসন, ওয়েস্টন ম্যাককেনি, টাইলার এডামস, টিমোথি ওয়েয়াহ্, এবং জিওভানি রেইনা’র মত প্রতিভারা উপস্থিত রয়েছেন।

স্টারস এন্ড স্ট্রাইপস খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র দলটি কোয়ালিফাইং স্টেজে তাদের ঘরের মাঠে খেলা সবকটি ম্যাচেই জয়লাভ করেছিল, এবং এবারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড, ইরান ও ওয়েলস সমৃদ্ধ একটি প্রতিযোগিতামূলক গ্রুপ থেকে নক আউট পর্যায়ে অবতরণ করতে পারলে তারা নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করতে পারবে। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে তারা প্রথম ও শেষ বারের মত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছিল, এবং এবার তাদের নিকট অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলেও তাদের অসাধারণ সব যুবা প্রতিভাগুলি সময়মত প্রষ্ফুটিত হলে তারা কোয়ার্টার ফাইনাল কেন, তার চেয়ে বড় স্বপ্নও দেখতে পারবে।

সেনেগাল (Senegal)

গ্রুপ এ হয়তো এবারের ফিফা বিশ্বকাপের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক গ্রুপ (গ্রুপ অব ডেথ) নয়, তবে এই গ্রুপটিতেই অবস্থান করছে বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি ডার্ক হর্স। 

তেরাংগা লায়নস খ্যাত সেনেগাল এবারের বিশ্বকাপে কাতার, নেদারল্যান্ডস ও ইকুয়েডরের পাশাপাশি গ্রুপ এ তে অবস্থান করছে, এবং টুর্নামেন্টটিতে আফ্রিকান সমর্থকদের জন্য তারাই সবচেয়ে বড় আশার প্রতীক। মোহাম্মদ সালাহ্ এর মিশর দলকে ২০২১ সালের আফ্রিকান নেশনস কাপের ফাইনালে এবং বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়িং পর্যায়ের সর্বশেষ ম্যাচে হারিয়ে সেনেগাল তাদের ক্ষমতার জানান দিয়েছে, এবং বর্তমানে বেশ ভালো ফর্ম পার করছে। 

২০০২ সালে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ ফুটবল খেলতে নেমেই তারা তৎকালীন বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে একটি অঘটনের জন্ম দেয়, এবং সেবার তারা বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালেও পৌঁছে যায়। বিশ্বকাপ ফুটবলে তাদের সর্বশেষ আউটিং অবশ্য খুব একটা স্মরণীয় ছিল না, কারণ ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে ফেয়ার প্লে টাই ব্রেক এর দরুণ তারা গ্রুপ পর্যায় থেকেই বিদায় নেয়। তবে এবারের কাতার বিশ্বকাপ ২০২২ এ আরো ভালো কিছু অর্জনেত লক্ষ্যে সেনেগাল দলটি বেশ বদ্ধপরিকর।

পড়ুন:  জানুয়ারি ট্রান্সফার উইন্ডো থেকে যা যা প্রত্যাশা করা যায়

২০ বছর আগের সেই দূর্দান্ত সেনেগাল দলটির একটি অংশ ছিলেন আলিউ ছিসে, যিনি কি না বর্তমানে দলটির হেড কোচের দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্বকাপে প্রবেশের পূর্বে এমনটিই মনে হচ্ছে যে, সেনেগালই সবচেয়ে ইন-ফর্ম দল হিসেবে টুর্নামেন্টটি শুরু করতে যাচ্ছে। তবে, আশার গলায় লাগাম লাগিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে গ্রুপ পর্যায় পার করার লক্ষ্যেই নিজের দলকে মাঠে নামাবেন ছিসে, এমনটিই সকল আফ্রিকান সমর্থকদের প্রত্যাশা। আফ্রিকান চ্যাম্পিয়নদের নিকট রয়েছে অসাধারণ সব খেলোয়াড়দের ছড়াছড়ি, যার মধ্যে অন্যতম হলেন বর্তমান বায়ার্ন মিউনিখ ফরোয়ার্ড সাদিও মানে, চেলসি গোলকিপার এডুয়ার্ড মেন্ডি, চেলসি ডিফেন্ডার কালিদু কুলিবালি, এভারটন মিডফিল্ডার ইদ্রিসা গানা গে, ক্রিস্টাল প্যালেস মিডফিল্ডার চেইখু কুইয়াতে, ওয়াটফোর্ড উইংগার ইসমাইলা সার প্রমুখ। তাদের এই প্রতিভার ভান্ডার কোনক্রমেই ছোট করে দেখা যাবে না।

বর্তমানে সেনেগাল তাদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ফিফা র‍্যাংকিংয়ে (১৮তম) অবস্থান করছে, এবং তারাই আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে ফিফা বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে পৌঁছানোর গৌরব অর্জন করতে পারে। তাদের ভক্তরা গ্যালারিতে তাদের সেই কুখ্যাত লেজার পয়েন্টারগুলি আনুক বা নাই আনুক, নিজেরা উপস্থিত থেকে তাদের দলকে প্রচুর উদ্দীপনার জোগান দিবেন, সে ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই।

Share.
Leave A Reply