...

এর আগে চেলসি’র বিপক্ষে ১৪ ম্যাচে ১০টি হার ও ৪টি ড্র’য়ের রেকর্ড নিয়ে মাঠে নেমে গত উইকেন্ডে তাদেরকে ৪-১ গোলে পরাজিত করে ব্রাইটন এন্ড হোভ এলবিয়ন। নিরপেক্ষ ফুটবল প্রেমীদের জন্য এর চেয়ে রোমাঞ্চকর ফলাফল আর কি হতে পারে!

৪-১ গোলের এই বিশাল পরাজয়টি ছিল নতুন কোচ গ্রাহাম পটারের অধীনে চেলসি’র প্রথম পরাজয়, তাও আবার তার সাবেক ক্লাবের বিপক্ষেই। রোবার্তো ডি জার্বি’র শিষ্যরা চেলসিকে বিভিন্ন ধরণের ভুল করতে বাধ্য করে, এবং ম্যাচের প্রথমার্ধেই একটি ৩-০ গোলের লিড নিয়ে নেয়।

তারই মধ্য দিয়ে নতুন ম্যানেজারের অধীনে চেলসি’র টানা ৯ ম্যাচের অপরাজিত থাকার রেকর্ডটি ভেস্তে যায়। তবে, এমন একটি হতাশাজনক ও আকষ্মিক পারফর্মেন্স ও ফলাফলের পরেও কেন চেলসি সমর্থকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন না? এ ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করব আমরা এই নিবন্ধটিতে। চলুন, শুরু করা যাক!

একটি আকষ্মিক অফ-ডে (An Off-Day)

দুই দলের জন্যই একটি আবেগঘন ও কঠিন ম্যাচের শুরুতেই ভাগ্য ছিল ব্রাইটনের অনুকূলে। চেলসি’র জন্য যেসকল বিপদের আশঙ্কা ছিল, তার সবগুলোই বাস্তবে রূপ নিয়েছিল। ম্যাচের শুরুতেই থিয়াগো সিলভা দুই দুইটি গোল লাইন ক্লিয়ারেন্স করলেও ৫ মিনিটের মাথায় শেষ পর্যন্ত ব্রাইটন লিড নিয়েই নেয়। সেই লিডটি তাদেরকে এনে দিয়েছিলেন তাদের বেলজিয়ান সুপারহিরো লিয়ান্দ্রো তোসার্দ।

খুব জলদিই এটি বোধগম্য হয়ে উঠেছিল যে, মাঠে এবং মাঠের বাইরে (অর্থাৎ গ্যালেরিতে) ম্যাচটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বসেছে ব্রাইটন, এবং তাদের খেলার আগা মাথা যেন বুঝেই উঠতে পারছিল না পটারের অল ব্লুস’রা।

চাপের মুখে প্রথমার্ধের পূর্বেই চেলসি দুই দুইটি আত্মঘাতী গোল হজম করে বসে। এ যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা! চেলসি’র আক্রমণাত্মক উইং ব্যাক যুগলের পেছনের ফাকা স্পেস এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে সিগালস’রা। ফলে, ম্যাচের বেশির ভাগ সময় জুড়েই অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটান চেলসি’র তিন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার — ট্রেভো চালোবাহ্, থিয়াগো সিলভা, এবং মার্ক কুকুরেয়া। এছাড়া, চেলসি’র তিন-খেলোয়াড় বিশিষ্ট মিডফিল্ডে কোন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এর অনুপস্থিতি গ্রাহাম পটারের দলটির জন্য খেলার নিয়ন্ত্রণ নেওয়াটা আরো কঠিন করে দেয়, তা পজিশনে থাকাকালেই হোক বা তা ব্যতীত। সেই ট্যাকটিকাল ভুলটির সুযোগ নেয় ব্রাইটন।

যেমনটি গ্রাহাম পটার তার চেলসি যুগের শুরু থেকেই করে আসছেন, এই ম্যাচটিতেও তিনি ঠিক একইভাবে তার দলের ফর্মেশন পরিবর্তন করে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে চলে যান, এবং দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই তিনি সেটির ইতিবাচক প্রভাবও লক্ষ্য করেন। তারই জের ধরে কাই হাভার্টজ এর করা অনবদ্য একটি গোলের মাধ্যমে চেলসি একটি গোল পরিশোধ করে, এবং কিছু সময়ের জন্য হলেও খেলায় ফিরে আসে।

তবে, ব্রাইটন তাদের নিজস্ব খেলা বজায় রাখে, রক্ষণভাগে কোন প্রকার স্পেস প্রদান করে না, এবং ম্যাচের অন্তিম পর্যায়ে আরও একটি গোল করে চেলসিকে একটি শোচনীয় হ্যালোয়িন উপহার দেয়।

দৃঢ়তার খোঁজে (Finding Solidity)

সব মিলিয়ে, গ্রাহাম পটার আসার পর থেকে চেলসি’র আক্রমণ আগের চেয়ে অনেকটাই সচল ও সফল আকার ধারণ করেছে ঠিকই, তবে তার আগমণের পর থেকেই তাদের রক্ষণভাগে দেখা দিয়েছে একের পর এক ইঞ্জুরিজনিত বাঁধা, যার ফলে পটার এখন অবধি তার পূর্ণাঙ্গ কাঠামোটি দাঁড়া করাতে পারছেন না।

এই ইংলিশ ম্যানেজারের নিয়োগের পর থেকেই চেলসি ডিফেন্সের সব রাঘব বোয়াল যেমন ওয়েসলি ফোফানা, কালিদু কুলিবালি, রিস জেমস, এবং এমনকি এনগোলো কান্তেও ইঞ্জুরি নিয়ে মাঠের বাইরে অবস্থান করছেন। ডিফেন্সিভ এসব পজিশনে এত সব অনুপস্থিতি চেলসি’র ডিফেন্সিভ দৃঢ়তার উপর একটি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে পটারকেও বার বার দলে পরিবর্তন আনতে হয়েছে, এবং জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালাতে হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, থমাস টুখেলের সময় থেকেই চেলসিতে এই ডিফেন্সিভ অক্ষমতা বজায় ছিল। গ্রাহাম পটার দলটির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সেই অগোছালো ডিফেন্সকে কিছুটা আকৃতি প্রদান করতে সক্ষম হয়েছেন, তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দুই মাস ধরে তার দলকে প্রচুর ম্যাচ খেলতে হয়েছে, এবং সব মিলিয়ে তিনি বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছেন।

তারপরও এটি মানতেই হবে যে, পটারের সাবেক দলের বিপক্ষে, তাও আবার তাদেরই হোম মাঠে (অ্যামেক্স স্টেডিয়ামে), এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে কেবলমাত্র তিনজন ডিফেন্সিভ-মাইন্ডেড খেলোয়াড়কে নিয়ে মাঠে নামাটা কিছুটা হলেও বোকামির মধ্যেই পড়ে। তার ঠিক আগের ম্যাচেই মিডউইকে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগে রেড বুল সালজবার্গও চেলসি’র উইং ব্যাকদের ফেলে যাওয়া সেসব স্পেসকে কাজে লাগিয়েই তাদেরকে ভুগিয়েছিল। তবে, সেটি থেকে সঠিক শিক্ষা অল ব্লুস’রা নেয়নি বলেই মনে হয়েছে।

সাবেক এই সোয়ানসি সিটি ম্যানেজার ব্রাইটনের বিপক্ষে পরাজয়টিতে নিজের ভুল স্বীকারও করেছেন ম্যাচ-পরবর্তী প্রেস কনফারেন্সে।

সেখানে তিনি বলেন, “যখন আপনি কোন একটি ম্যাচে হারেন, তখন আপনার উচিৎ সে ম্যাচে করা আপনার ভুলগুলোকে চিহ্নিত করা, বিশ্লেষণ করা, এবং সেগুলি শুধরানোর চেষ্টা করা। এটি আমার দায়িত্বের একাংশ, এবং পুরো প্রক্রিয়াটিরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যেহেতু সেই জায়গাটিতেই ভুল করেছি, সেহেতু এখানে আমাকেই দায়িত্ব নিতে হবে, এবং এর চেয়ে ভালো করার চেষ্টা করতে হবে।

” এখানে আমি ব্রাইটনকেও অভিনন্দন জানাতে চাই, কারণ তারা তাদের জায়গা থেকে সবকিছু ঠিক করেছে। এমনটিও বলা যাবে না যে, আমরা কোন সুযোগই তৈরি করতে পারিনি, যদিও স্কোরলাইনের দিকে তাকালে হয়তো তেমনটিই মনে হতে পারে। আমরা প্রতিপক্ষের ডি বক্সে প্রায় তাদের সমানই টাচ প্রদান করতে পেরেছি। তারা দুইটি আত্মঘাতী গোল পেয়েছে, আমরাও কিছু গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেছি, তবে শেষ পর্যন্ত এটিই সত্য যে, আমাদের ডিফেন্সে অনেক বেশি স্পেস আমরা প্রদান করেছি, এবং অবশ্যই, সেটির দায়িত্ব পুরোপুরি আমাকেই নিতে হবে।”

শারিরিক চাহিদা (Physical Output)

ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ ২০২২ এর আগ পর্যন্ত চেলসি’র জন্য অপেক্ষা করছে একটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ফিক্সচার তালিকা, যেখানে প্রায় প্রতি তিন দিনেই তাদেরকে একটি করে ম্যাচ খেলতে হচ্ছে। এবং, সেই অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন ফিক্সচার তালিকার নেতিবাচক প্রভাবও দলটির উপর পড়তে শুরু করেছে, কারণ ট্রেনিং গ্রাউন্ডে তারা পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছে না। এছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক অ্যাওয়ে ম্যাচের প্রভাব তো আছেই!

অ্যামেক্স স্টেডিয়ামে ব্রাইটন এন্ড হোভ এলবিয়ন এর বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল অক্টোবর মাসে তাদের ৯ম ম্যাচ, যার মধ্যে ৬টি ম্যাচেই তাদেরকে খেলতে হয়েছে ঘরের মাঠের বাইরে।

ম্যাচটিতে চেলসির শুরুটা মোটেও ভালো না হলেও, এটি মানতেই হবে যে একটি সম্পূর্ণভাবে ফ্রেশ বা তর্তাজা ব্রাইটন দলের বিপক্ষে তাদেরকে বেশ ক্লান্তই মনে হয়েছে, কারণ তার ঠিক তিন দিন আগেই তাদের দলের ৯ জন খেলোয়াড়ই অস্ট্রিয়া থেকে সফর করে এসেছিল (আরবি সালজবার্গ এর বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লীগের ম্যাচ)।

ফলে, চেলসি ম্যাচটিতে যে কামব্যাক করার জন্যও অপারগ ছিল, সেটিও খুব তাড়াতাড়িই সবার বোধগম্য হয়ে উঠেছিল, কারণ ক্লান্তির ছাপ তাদের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের মুখেই বিদ্যমান ছিল। তাদের সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস লীগ গ্রুপ স্টেজ ম্যাচে ডাইনামো জাগ্রেব এর বিপক্ষে চেলসি তাদের দলে বেশ কিছু পরিবর্তন আনবে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে, কারণ তারা ইতিমধ্যে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রতিযোগিতাটির নক আউট পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে।

এই ডেড-রাবার ম্যাচটি তাই তাকে একটি সুযোগ দিবে নতুন নতুন চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর, কিছু ক্লান্ত খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দেওয়ার, এবং কিছু ফ্রিঞ্জ বা বেঞ্চের খেলোয়াড়দের খেলার সুযোগ করে দেওয়ার, যা সেসকল খেলোয়াড়দের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের জন্য সেই বিশ্রামটি হতে পারে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ কাতার বিশ্বকাপ ২০২২ শুরু হওয়ার পূর্বে চেলসি’র জন্য বেশ কিছু কঠিন খেলা অপেক্ষা করছে, যেমন আর্সেনাল, ম্যানচেস্টার সিটি, এবং নিউক্যাসেল ইউনাইটেড।

যেহেতু খুবই অল্প সময়ের মধ্যেই তার দলকে প্রচুর পরিমাণে ম্যাচ খেলতে হয়েছে, এবং তিনি দলটিকে সেভাবে গুছিয়ে নেওয়ার খুব বেশি সময়ও পাননি, সেহেতু গ্রাহাম পটারের চেলসিকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার সময় এখনও আসেনি। চেলসি এবং গ্রাহাম পটার যেমন একটি দৃঢ় এবং সফল একটি দল তৈরি করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, সেই প্রক্রিয়ায় এমন কিছু হতাশাজনক ফলাফল আসবেই। তবে, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভুলগুলো না শুধরালে পটারের নিয়তিও যে হবে থমাস টুখেল এর মতই, সে ব্যাপারেও কোনই সন্দেহ নেই।

Share.

Leave A Reply

Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.